আজাদ মনসুর

সাংবাদিকতার আরেকটি চর্চা পাঠকদের বিভ্রান্তে ফেলে। যাকে আমরা হলুদ সাংবাদিকতা বলে থাকি। এ ধরনের সাংবাতিকতায় ভাল মন্দ খোঁজ-খবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হল সাংবাদিকতার রীতিনীতি তথা নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়া। হলুদ সাংবাদিকতা কোন সাংবাদিকের জন্য গর্বের বিষয় নয় বরং এটি লজ্জার বিষয়। এতো রং থাকতে হলুদকেই কেন বেছে নেওয়া হলো, এমন কিছু প্রশ্নের উত্তরের কৌতুহলও দীর্ঘদিনের। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনকেই হলুদ সাংবাদিকতা বলা হয়। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হল সাংবাদিকতার রীতিনীতি তথা নীতি নৈতিকতা ছাপিয়ে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানোই অন্তরায় বৈকি! মজার ব্যাপার হলো, সাংবাদিকতায় যাদের এতো অবদান তাদের একরকম পাগলামির জন্যই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা পরিভাষাটি।
পঞ্চম পর্বের শুরুতেই সদ্য প্রয়াত ক্ষণজন্মা বয়সে আমার বড়, তবে মিশেছি কাঁদে কাঁদ মিলে। মোটেও বুঝার উপায় ছিলনা যে আমাদের মধ্যে একটা বয়সের প্রার্থক্য রয়েছে। বন্ধুবৎস সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ শাকিল আমাদের ছেড়ে না ফেরা দেশে চলে গেছেন। আমাদের থেকে চিরজীবী হয়েছেন। যেখান থেকে কেউ কোন দিন ফিরেনি। তার মাগফিরাত কামনা করছি আর পরিবারটির প্রতি গভীর মমতা ও শোক সইবার ধৈর্য যাতে আল্লাহ তাদের দেন। এই কামনা করে কক্সবাজারের সাংবাদিকতার যতকথার আজকের পঞ্চম পর্ব শুরু করছি।
বলছিলাম, ওই সব পত্রিকায় নিয়োজিত কম্পোজম্যান তথা পত্রিকার মেকাপম্যান বিভিন্ন অনলাইন ঘুরে বাছাইকৃত কিছু সংবাদ কপি করে একটি ফাইলে পেষ্ট করে। সংবাদগুলোর কেডিট লাইন পরিবর্তন করে পত্রিকাগুলোতে ছাপায়। কথা হচ্ছে, একটা পেশাদার সংবাদপত্রের জন্য এটি মোটেও কাম্য নয়। স্থানীয় পত্রিকার জন্য ডেস্ক রিপোর্ট দরকার আছে তবে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যদি ডেস্ক রিপোর্ট নির্ভর পত্রিকা হয়! জাতীয় পত্রিকায় আমরা সংবাদ পড়ি, বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে সংবাদ পড়ি কিন্তু বিশেষ করে স্থানীয় সংবাদের জন্য আমরা তাকিয়ে থাকি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে। পত্রিকার মৌলিকত্ব বলে একটা কথা আছে।
প্রত্যেক গণমাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকে। সেটা সম্পাদকীয় নীতি। এর বাইরে গণমাধ্যম মোটামুটি স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতিগ্রহণ করতে পারে। গণমাধ্যমের মালিক বা মালিক গোষ্ঠী তাদের পছন্দমতো কিছু নীতি ঠিক করতে পারে। সেই নীতির আলোকেই প্রতিটি গণমাধ্যম পরিচালিত হয়। গণমাধ্যমে কর্মরত সব সাংবাদিক সেই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে থাকেন। এর বাইরে প্রত্যেক গণমাধ্যমের একটা নৈতিকতা থাকে। যাকে আমরা এথিকস বলে জানি। গণমাধ্যমের নীতি যাই হোক না কেন, এথিকস তাকে মেনে চলতেই হবে। এগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একটি পেশাদার সংবাদপত্র বলতে যা বুঝায়, ওই সংবাদপত্রের মালিক বা মালিক গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হবে। তাদের নির্ধারিত নীতি দিয়ে একটি পত্রিকার পরিবেশ বজায় রাখে। এটা দিয়েই কিন্তু ওই পত্রিকার ভবিষ্যত নির্ভর করে।
ধরে নিলাম একটি সংবাদপত্র (বিশেষ করে আমি স্থানীয় পত্রিকার কথা যদি বলি) পরিচালনা সম্পাদক, একজন সম্পাদক, সহ সম্পাদক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), মফস্বল সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক, নিজস্ব প্রতিবেদক, স্টাফ রিপোর্টার, শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্ট, শহর প্রতিনিধি, বিভিন্ন উপজেলা প্রতিনিধি, কোর্ট প্রতিনিধি, ম্যানেজার, সার্কোলেশন ম্যানেজার, বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক নিয়ে মূলত এই কয়েক পদবীর শক্ত টিম বিন্যাসে ভাস্বর হতে পারে। যদি সম্পাদক নীতিতে পত্রিকাটির টিম ম্যানেজম্যান জোরালো ভাবে ঠিক করতে পারেন এবং তাদের কর্ম পরিকল্পনায় নিজেদের ধরে রাখতে পারেন তাহলে পত্রিকাটি ঠেকায় কে! যার কাজ তাকেই করতে হবে।
জাতীয় পত্রিকায় যদিও সংবাদ বিন্যাসের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বিট হয়। আদালত, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, শিক্ষা, সাহিত্য, অনুসন্ধানি, ক্রাইমসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলাদা বিটের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু স্থানীয় পত্রিকায় যদিও এ ধরনের সুযোগ তেমন থাকেনা। বার্তা সম্পাদক নির্ধারণ করে দেন যে কে কোন প্রোগ্রামে যাবেন বা কে কোন ধরনের সংবাদ করবেন। স্টাফ রিপোর্টার যারা আছেন তাদেরকে ক্ষেত্র বিশেষে সব সংবাদ কাভার করতে হয়।
কক্সবাজারের স্থানীয় পত্রিকার কয়টি সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় নীতি চালু রয়েছে আমি জানিনা। তবে এইটুকু জানি যে, বর্তমানে নিয়মিত প্রায় ২০-২২টি পত্রিকা ছাপা হয়। ওই সব পত্রিকায় ১-৩টি পত্রিকা ছাড়া কোন পত্রিকা কয়েকটি পদ ছাড়া বাকি পদগুলোর অস্থিত্ব নেই। ফলে একজনের কাজ আরেকজনকে করতে হয়। ফলে সম্পাদকীয় নীতিতে ওইসব পত্রিকা তাদের স্বকীয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। আমি হলফ করে বলতে পারি ওই নিয়মনীতি ঠিক রেখে পত্রিকা ব্যবস্থাপনায় তাদের সম্পাদকীয় নীতি পুরোপরি কার্যকর করতে পারলেই সংবাদপত্রের পেশাদারিত্ব আসে। আর ওই সকল সংবাদপত্রে যারা সাংবাদিকতা চর্চা করেন তারাই প্রকৃত পেশাদারিত্ব নিয়ে সাংবাদিকতা করছে বলে আমি মনে করি।
আবার এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা ভাল যে, সম্পাদকীয় নীতিতে যারা পত্রিকার প্রয়োজনীয় পদের জনবলদের মাসিক বেতন/ভাতাদি যথা সময়ে দিচ্ছে কিনা এটাও ভাবার বিষয়। কিছু সংবাদপত্রে সব ঠিক আছে তবে বেতন/ভাতাদি সঠিক ভাবে দেয়া হয়না। পত্রিকাটির মোটামুটি মাঠ পর্যায়ে মান থাকার কারণে ওই পত্রিকায় নিয়োজিত সাংবাদিকরা বেতন/ভাতাদি না পেলেও লজ্জায় কাউকে বলেন না। আবার মালিকপক্ষ ডিএফপি টিকিয়ে রাখতে প্রত্যেক জনবলের মাসিক হাজিরা হাজিরা সিট ও মাসিক বেতন/ভাতাদি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদি পাচ্ছে মর্মে স্বাক্ষর নিশ্চিত করে কর্মরত সাংবাদিকদের বেতনক্রম ঠিক করে চলচিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে আগত অডিট কর্মকর্তাকে বিশাল অংকের মাসোহারা দিয়ে সব ঠিক আছে মর্মে প্রত্যয়ন নিয়ে ডিএফপি বহাল রাখেন। এখানে পত্রিকার বর্তমান সার্কোলেশন, কর্মরত কর্মচারীদের বেতনক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর অডিট কার্য পরিচালনা করা হয়।
আমরা শুধু বলে বেড়াচ্ছি, কক্সবাজারে যে হারে সাংবাদিক রয়েছে দেশের অন্য কোন জেলায় নেই। আবার এটাও সত্যি যে কক্সবাজারের মত স্থানীয় সংবাদপত্র অন্য কোন জেলায় নেই। সংগত কারণে জেলায় যে হারে স্থানীয় সংবাদপত্র সে হারে সংবাদকর্মী তু থাকবে এটা স্বাভাবিক। দেখার বিষয় সব সংবাদপত্র সংবাদপত্রের কিঞ্চিত নীতি ও সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করছে কিনা। আমার জানা ও দেখা সর্তে ১-৩টা পত্রিকা ব্যতিত অন্য কোন পত্রিকা এই চর্চা হয় না। তাহলে তারা কিভাবে চলেন…(প্রিয় পাঠক, প্রত্যেক পর্ব পড়ার সুবিধা বিবেচনায় পর্বগুলো যাতে সংক্ষেপ করি অনেকে অনুরোধ করেছেন। তাই আজকের মত পঞ্চম পর্ব শেষ করলাম। পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ) চলবে…

আজাদ মনসুর (এম.এ, এলএল.বি) শেষবর্ষ
আইটি স্পেশালিষ্ট, প্রণেতা-কক্সবাজার সাংবাদিক কোষ, সভাপতি-কক্সবাজার সাংবাদিক সংসদ (সিএসএস)
azadcox90@gmail.com ০১৮৪৫-৬৯ ৫৯ ১৬