– অধ্যাপক আকতার চৌধুরী

২য় পর্ব
ইহরামের কাপড়টা পড়ার পর থেকে শরীরে কিছু অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। আমি যেন জীবন্ত একটা লাশ। শরীরটা পালকের মত হালকা । ভিন্ন একটা জগতে ভেসে বেড়াচ্ছি। যেন চুম্বকীয় আবেশে আমার হৃদয় কম্পাস পুর্ব-পশ্চিম মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। যতক্ষণ পৌছতে পারছি না ততক্ষণ মনে শান্তি পাচ্ছি না। হৃদয়ে গানের সুর – দে দে পাল তুলে দে , মাঝি হেলা করিস না । ছেড়ে দে নৌকা, যাব মক্কা মদীনা!

এই সাদা কাপড়ে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের কাজ সমাধা করছি। কক্সবাজার ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর স্বত্তাধিকারী ছোটভাই তোফাইল উদ্দিন এর কাছ থেকে আমাদের ওমরাহ’র ভিসা ও বিমানের টিকেট প্রসেসিং করা । সে আসার আগে ওমরাহ ও হজে¦র উপর আমাদের একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। সাথে ইফতারও । তাই ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম কিছুটা সহজ হয়েছে। তবে আমি, কামরুল মামা ও নাসির ভাই স্বস্ত্রীক ৬জনের একটা গ্রুপ করে ফেলি কক্সবাজার বিমান বন্দর থেকে। ফলে উনাদের পূর্বাভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কাজ সহজ করে দেয়। সেটা মক্কা মিছফালা গাড়ী পার্কিংয়ে থামা ও আত্মীয় স্বজনের হাতে আমাদের সমর্পন পর্যন্ত যথেষ্ট উপকারে লেগেছে। যেমন , ইমিগ্রেশন কাউন্টার খোজে বের করা , মালামাল টানাটানি, ওজনে সবার মধ্যে ভাগ করে নেয়া । জেদ্দা ও মক্কায় পৌঁছার পর লোকেশনের বর্ণণা দিয়ে আমার আত্মীয় স্বজনদের মোবাইলে জানানো সব কিছুতেই যথেষ্ট উপকারে লাগে।
সে জন্য বলব , যারা পবিত্র হজ্ব বা ওমরাহতে আসতে চান তারা যেন পূর্বাভিজ্ঞতা সম্পন্ন সহযাত্রী বেছে নেন।
বিমানে উঠার আগে দেখি ইমিগ্রেশন শেষ করে যারা বসে আছে তাদের অনেকে পরিচিত। কক্সবাজারের যাত্রীর সংখ্যা কম না। মনে হচ্ছে একখন্ড কক্সবাজার। এবারে সর্বোচ্চ সংখ্যক ওমরাহ হজ্ব যাত্রী। রাজনৈতিক , অরাজনৈতিক , পেশাজীবি , ব্যবসায়ী , চাকুরীজীবি এমন কী শিক্ষার্থীও আছে। এত ওমরাহ যাত্রী দেখে সত্যি অবাক হতে হয় । দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী পরিমাণ ভাল! নিন্দুকেরা বলে ‘বাবা’র জোরেও নাকি এমনটি অনেকের হয়েছে। আমি এমনটি বলতে চাইনা । কারণ যারাই পবিত্র ওমরাহ’র হজ্ব যাত্রী তারা আল্লাহর সম্মানিত মেহমান। ভেতরের বিষয় আল্লাহই ভাল বলতে পারবেন।

বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৩৫ ফ্লাইটটি অনেক বড়সড় বলা যায়। প্রায় ৪ শতাধিক যাত্রী ধারণ ক্ষমতার। একদম পেছনের সারিতে জানালার পাশে আমাদের সিট পড়েছে। ৬ ঘন্টা ৪০ মিনিটের পথ ঢাকা-জেদ্দা । ১২০ কি.মি দুরে থাকতেই বিমানের এনাউন্সমেন্ট – বিমান মিকাত অঞ্চল এর কাছাকাছি , ইহরাম পড়ে নিন।

তখন কিছুটা ব্যস্থতা দেখা গেল বিমানে। ইহরামের কাপড় পড়ার জন্য অযু ও ২ রাকাত নফল নামাজের প্রয়োজন হয় । কিন্তু একি অবস্থা । অনেকে বিমানের টয়লেটে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে সিটে। বাথরুম ইতিমধ্যে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে এয়ার হোস্টেস ব্যবহার করতে যাত্রীদের নিষেধ করছিল। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম। ঢাকা থেকে ইহরাম পড়ে এসে ভাল করেছি। তাই বলব , আপনারা যারা হজ্ব কিংবা ওমরাহ করতে আসবেন ঢাকা অথবা দেশে সুবিধা জনক জায়গা থেকে ইহরামটা পড়ে এলে ভাল হয়।

আসুন মিকাত সম্পর্কে জেনে নিই  :

স্থান অথবা কালের সীমারেখাকে মিকাত বলে। ইহরাম ব্যতীত যে স্থান অতিক্রম করা যায় না,অথবা যে সময়ের পূর্বে হজ্জের ইহরাম বাধা যায় না সেটাই হলো মিকাত। যারা মক্কা মুকাররামার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে, আকাশ পথে হোক কিংবা সমুদ্র পথে বা স্থল পথে হোক, তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রমের পূর্বেই ইহরাম পরিধান করা ওয়াজিব। সেই নির্দিষ্ট স্থানকে মিকাত বলে।যদি কেউ ইহরাম ব্যতীত মিকাত অতিক্রম করে, তবে তাকে মিকাতে ফিরে গিয়ে ইহরাম পরিধান করে আসতে হবে,না হলে দম ওয়াজিব হবে এবং তাওবা করতে হবে।
মিকাত হলো মোট পাঁচটি। যথাঃ-

১। যুল হুলায়ফাঃ এটি মক্কা শরীফ থেকে ৪২০ কিলোমিটার উত্তরে মদীনার উপকন্ঠে অবস্থিত। বর্তমানে আবার আলি বলে জায়গাটি পরিচিত। মদিনাবাসীসহ এবং ওই পথ হয়ে যারা আসেন তাদের মিকাত হলো যুল হুলায়ফা।

২। জুহফাহঃ এ জায়গাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত হওয়ায় রাবেগ থেকে মানুষেরা ইহরাম বাঁধে। মক্কা থেকে রাবেগের দূরত্ব ১৮৬ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার লোকজন,পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকার লোকজন, লেবনান,সিরিয়া,জর্ডান ও ফিলিস্তিনবাসীরা এ জায়গা হতে ইহরাম বাঁধেন।

৩। কারনুল মানাযেলঃ  মক্কা শরীফ থেকে ৭৮ কিলোমিটার পূর্বে তায়েফ শহরের পশ্চিমে অবস্থিত। ইরাক,ইরান ও অন্যান্য উপসাগরীয় অঞ্চলের লোকদের মিকাত হলো এ কারনুল মানাযেল।

৪। ইয়ালামলামঃ  এ জায়গাটি মক্কাশরীফ থেকে ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহিত সাগরের ধারে অবস্থিত। এলাকাটি “সাদিয়া” নামেও পরিচিত। যেসব দেশের লোকেরা এখান থেকে ইহরাম বাঁধে সেগুলো হলো-
১। ইয়ামেন, ২। বাংলাদেশ, ৩। ভারতবর্ষ, ৪। চীন, ৫। ইন্দোনেশিয়া, ৬। মালয়েশিয়া, ৭। দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্বের দেশসমূহ।

৫। যাতু ইরকঃ মক্কা শরীফ থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। বর্তমানে এ মিকাতটি পরিত্যক্ত। কেননা, ওই পথ হয়ে বর্তমানে কোনো রাস্তা নেই।স্থল পথে আসা পূর্বাঞ্চলীয় হাজিরা বর্তমানে সাইল অথবা যুল-হুলায়ফা থেকে ইহরাম বাঁধেন।

হাদিস অনুযায়ী মিকাতের বাইরে থেকে আসা হাজিদের জন্য মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব। তবে যারা মিকাতের সীমানার অভ্যন্তরে বসবাস করেন তাদের অবস্থানের জায়গাটাই হলো তাদের মিকাত। অর্থাৎ যে যেখানে আছে সেখান থেকেই হজ্জের ইহরাম বাঁধবে। তবে মক্কার হারাম এরিয়ার বাইরে- যেমন  আয়েশা মসজিদে গিয়ে ইহরাম বাঁধতে হবে। (এই অংশটি সংগৃহিত)

চলবে ….

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (১ম পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৩য় পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৪র্থ পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৫ম পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৬ষ্ঠ পর্ব)

একটি সাদা কাফনের সফর নামা – (৭ম পর্ব)