বাংলা ট্রিবিউন:

বেশ কিছু ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নানা কারণে দিন দিন কমছে। তবে উল্টো হাওয়া বইছে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। মূল ব্যাংক না হলেও মূল ব্যাংকের ছত্রছায়ায় গড়ে ও বেড়ে ওঠা এসব বৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রতি মানুষের আস্থা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কিছু মূল ব্যাংকের আমানত না বাড়লেও উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানত। আর লেনদেন প্রক্রিয়া সহজ ও হাতের নাগালে হওয়ায় গত কয়েক বছরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনও অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগদ টাকার সংকটের কারণে অধিকাংশ ব্যাংক এখন ঋণ দিতে পারছে না। আবার ব্যাংকে সুদের হার কম হওয়ায় গ্রাহক আগ্রহ হারানোয় আমানতও আসছে না চাহিদা অনুযায়ী, একইভাবে ঋণ আদায়ও বাড়ছে না। ব্যাংকগুলোর এই নাকাল পরিস্থিতির ভেতরেও সু-বাতাস বইছে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং এখন আর্থিক লেনদেনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের যে কেউ যখন তখন ইচ্ছে করলেই লেনদেন করতে পারে। যে কোনও প্রয়োজনে টাকার দরকার হলে অল্প সময়ে যেটা পাচ্ছে।

তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চায় শহরের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের উন্নতি। এ কারণে গ্রাম এলাকায় ব্যাংকের শাখা স্থাপন, এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর যেহেতু এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যয় সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর তাই প্রতিনিয়ত এ দুটোর প্রসার ঘটছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক বেড়েছে তিনগুণ। এই সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত বেড়েছে ৫ গুণ। অথচ নগদ অর্থ না থাকায় মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। যার ফলে কমে গেছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। সব মিলিয়ে ১২টি ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো তহবিল আছে। বাকি ব্যাংকগুলো টাকা ধার করে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সাড়ে চার বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্ব নিম্নপর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ছিলেন ১০ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। সেই সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে ২৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৫ জনে উন্নীত হয়েছে। এসব গ্রাহক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন।  ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকদের জমানো টাকা ছিল ৭৯২ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এখন সেই জমার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম ও রেমিটেন্স বিতরণ এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারির পরের বছর ব্যাংক এশিয়া প্রথমে এ সেবা চালু করে।

গ্রাহকদের যেভাবে আকৃষ্ট করছে এজেন্ট ব্যাংকিং

মূলত, যেখানে ব্যাংকের শাখা নেই, সেখানে এজেন্টই হয়ে উঠেছে ব্যাংকের শাখা। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে গড়ে ওঠা এই এজেন্ট পয়েন্ট থেকে আমানত সংগ্রহ, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ, সুবিধাভোগীর কাছে রেমিটেন্সের অর্থ পৌঁছে দেওয়া, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ভাতাভোগীকে অর্থ প্রদান, অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স জানা, অ্যাকাউন্ট ফরম সংগ্রহ, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের আবেদন ফরম এবং চেক বই সংগ্রহ করতে পারেন গ্রাহকরা।

এই বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৯টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেছে। মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, সর্বমোট ৪ হাজার ৮৬৬টি এজেন্টের মধ্যে ৪ হাজার ৩৬৫টিই গ্রামে অবস্থিত। আর ৭ হাজার ৮৩৮টি আউটলেটের মধ্যে ৭ হাজার ৮৪টি গ্রামে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নতুন গ্রাহক হয়েছেন ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৫৮ জন। এই বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব খুলেছেন ২৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৫ জন। আগের বছরের মার্চে হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৭ জন। অর্থাৎ এক বছরে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে একবছরে জমার পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এই বছরের মার্চ পর্যন্ত গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট জমার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, এই বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২১০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চে ঋণের পরিমাণ ছিল ১২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ বিতরণও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিটেন্স বিতরণ বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। ২০১৯ সালের মার্চে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা রেমিটেন্স দেওয়া হয়েছে। আগের বছরের মার্চে যা ছিল ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রেমিটেন্স সরবরাহ বেড়েছে ১৬৮ শতাংশ।

লেনদেন বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়েও

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনও বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী শুধু এপ্রিল মাসেই ৩৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে যথাক্রমে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৬২৬ কোটি, ৩১ হাজার ৫১৩ কোটি, ৩৪ হাজার ৬৭৮ কোটি ও ৩৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এপ্রিলভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ৮৩ লাখ। যা আগের মাসে (মার্চ) ছিল ৬ কোটি ৭৫ লাখ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে মোবাইলের সক্রিয় গ্রাহক রয়েছে ২ কোটি ৯১ লাখ। এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা লেনদেন করেছেন গ্রাহকরা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মোট এজেন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৩ জন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মোবাইল রিচার্জ, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, টাকার আদান-প্রদান, বিমা প্রিমিয়াম জমাসহ নানামুখী ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বেড়েই চলেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আকার। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিটেন্সের টাকা গ্রাহকের কাছে পাঠানো, ক্যাশ ইন, ক্যাশ আউট, একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যজনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো, মোবাইল ফোনের এয়ার টাইম কেনা, পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট পেমেন্ট, সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা, এমনকি ডিপিএসও দেওয়া যায়।

সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরের বছর পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। মূলত, স্মার্টফোন উদ্ভাবনের পরে মোবাইল ওয়াপ (ওয়্যারলেস অ্যাপ্লিকেশন প্রটোকল) পদ্ধতির মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হয়।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মোবাইল অপারেটরভিত্তিক হলেও বাংলাদেশে এ সেবা ব্যাংকভিত্তিক। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ সেবা দিচ্ছে। বর্তমানে ২৯টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন নিয়েছে। তবে কার্যক্রমে আছে ১৬টি ব্যাংক।