আজাদ মনসুর:
সাংবাদিকতা করতে মৌলিক কাজের জন্য প্রয়োজন সময়, মনোযোগ এবং পরিশ্রম। এখানে দায়সারা গোছের কিছু করলে চলবেনা এখানে কঠোর পরিশ্রম দরকার, শুধু কয়েকদিনের জন্য নয়, অনবরত। এখানে মনোভাবের প্রয়োজন হতে পারে এবং অভ্যাসের প্রয়োজন নির্ঘাত হবে।

সাংবাদিকতার মৌলিক কাজের জন্য প্রয়োজন সময়, মনোযোগ এবং পরিশ্রমের পাশাপাশি কৌতূহল এবং জানার আগ্রহ থাকা বাঞ্চনীয় যা বিভিন্ন প্রশিক্ষণশালায় শিখেছি। সাংবাদিকতার মানেই হচ্ছে মানুষকে নতুন কিছু বলা। মৌলিক সাংবাদিকতার জন্য যে নৈপুণ্য দরকার সে বিষয়ে জানা আগ্রহ দীর্ঘদিনের। কক্সবাজারের সাংবাদিকতার যতকথা’র আজকে পর্ব তৃতীয়।

২০০৪ সাল কক্সবাজার শহীদ দৌলত ময়দানে বইমেলা চলছিল। বইমেলার সমাপনী দিনে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে প্রত্যেক পত্রিকায়। সে সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদ পাঠানো তেমন চালু হয়নি। হার্ডকপি দিয়ে আসতে হতো প্রতিটি স্থানীয় পত্রিকায়। ‘যখন ট্রেন আসবে এই শহরে’ ও ‘অষ্ট্রিক পুরুষ’ খ্যাত কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কক্সবাজার তথা বর্তমানে দেশের শূণ্যদশকে আধুনিক কাব্য জগতের অন্যতম কবি মনির ইউসুফ কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর স্টল থেকে আমাকে ডাকলেন। চলো দৈনিক সৈকতে যাব। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি দিয়ে আসি। আর তোমাকে ওই পত্রিকায় নিয়মিত কাজ করতে পারো মতো ব্যবস্থা করে দিয়ে আসা দরকার। আমি কারও কথা ফেলতে পারি না। এক বাক্যে চললাম কবির সাথে। দৈনিক সৈকতের বাজারঘাটাস্থ অফিসে গিয়ে সোজা সম্পাদক মাহবুবর রহমান মহোদয়ের কক্ষে। সম্পাদক আগে থেকে আমাকে চিনতেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনী দিতাম সৈকতসহ দৈনিক কক্সবাজারের ‘ঝিকিমিকি’ ও দৈনিক আজকের দেশ-বিদেশ পত্রিকার ‘দেশ বিদেশ সাহিত্য’ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সাহিত্য পাতায়। সম্পাদকের সাথে প্রাথমিক আলাপ শেষ করে শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে পত্রিকায় নিয়োজত বার্তা সম্পাদকের কাছে সৌজন্য স্বাক্ষাত করি। তখন ডেস্কে দেখা গেল তৌহিদ বেলাল, সাইফুর রহিম শাহিন ও প্রুফ রিডার হিসেবে নেছার আহমদকে। সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে সাইফুর রহিম শাহিন ও তৌহিদ বেলাল’র কাছ থেকে হাতে কলমে যেভাবে শেখা দরকার ওভাবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছি। ধরেন, আমি শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে বার্তা প্রধান একটা এসাইনমেন্ট দিলেন। দেয়ার সময় কি কি তথ্য উপাত্ত দরকার হয় তা জানিয়ে দিলেন। কোথায় গেলে কোন তথ্যটি পাওয়া যাবে, কার কার বক্তব্য দরকার এবং সংবাদটির ছবি লাগলে ওটাও জানিয়ে দিলেন। এখন পালা আমার। বার্তা সম্পাদকের দেয়া সাজেসন্স অনুসারে পরের দিন সংবাদটির বিষয়ে সরে জমিনে গিয়ে বিস্তারিত নোট করা, যাদের বক্তব্য নেয়া দরকার তাদের থেকে বক্তব্য নেয়া ও যেটি নিয়ে সংবাদ হবে ওই স্থানের ছবিসহ বিস্তারিত নিয়ে সন্ধ্যায় অফিসের ডেস্কে বসে আমার মত সংবাদ তৈরিতে ব্যস্ত হওয়া। সংবাদ শেষ করে বার্তা সম্পাদকের হাতে সংবাদটি ধরিয়ে দেয়া হয়। এখন পালা সংবাদটি নিয়ে বার্তা সম্পাদক চুলছেঁড়া বিশ্লেষণের। সংবাদটি যেভাবে সংযোজন বিয়োজন পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হয় তা করে আবার ওই সংবাদটির কপিটি আমাকে ধরিয়ে দেয়া হলো। সংবাদটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন তুমি কিভাবে সংবাদ করেছো আর আমি কি করলাম। দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য দেখো। এখন দেখলাম যেভাবে ঘষামাঝা হলো তাদে বুঝা গেল আমি সংবাদটি যেভাবে সূচনা করলাম তার পরিবর্তন হলো, কিছু শব্দের পরিবর্তন হলো, বাক্যের পরিবর্তন হলো সর্বোপরি একটি সংবাদকে যেভাবে রূপ দেয়া দরকার তার কোনটারই অসম্পূর্ণ নেই। এতে করে আমার বুঝতে সুবিধা হলো এবং পরের যে কোন সংবাদ তৈরিতে আমার কাজে আসবে। সংবাদের অনেক ধরনের রূপ আছে। অর্থ্যাৎ অনেক ধরনের সংবাদ বিট করা লাগে। প্রত্যেক সংবাদের ধরণ একেক রকম। উপরোক্ত কথাগুলো বলার অনেক যৌক্তিক কারণও আছে। যা আপনারা পাঠকরা পরে বুঝতে পারবেন। তখনকার সময়ে শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টাররা যেভাবে হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করতে পারতো, এখন তা নেই। তথ্য প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের কারণে তার পরিবর্তন এসেছে। কারও একটা সংবাদ কোন পোর্টালে পেলেই ‘কপি টু পেষ্ট’ হয়ে গেল সাংবাদিকতা। আর যিনি বার্তা সম্পাদকের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন তাঁর হাতে যখন মেইল থেকে সংবাদগুলো প্রিন্ট করে কম্পিউটার অপারেটর দেয়। তখন তিনি শুধু অকে লিখেই দায় ছাড়েন। ভিতরে কি লিখা আছে ওগুলো দেখার সময় কই তাঁর। এই চর্চা আবার সব পত্রিকায় হয়না। তারও একটা কারণ আছে যা পরবর্তী যে কোন পর্বে পড়তে পারবেন। কক্সবাজারে এখন যে সকল পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে ওই পত্রিকাগুলোতে উড়ে এসে দৌঁড়ে বসা বার্তা সম্পাদক হিসেবে সংবাদটি দেখভাল করেন। কোন সংবাদপত্রের জন্য কাম্য নয়। অভিজ্ঞতার যদিও বালায় নেই সেখানে তাঁর একাডেমীক স্ট্যাটাস কি এটাও দেখছি কিভাবে? কারণ সম্পাদক যিনি তিনিও বকলম। তাঁর উচিত সাংবাদিকতার যেসব পদের ধারাবাহিকতা রয়েছে অন্তত ওই সব সাংবাদিকরা পদগুলো অতিক্রম করছে কিনা এটা অন্তত দেখা উচিত। তা করেই শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টার তু দূরের কথা, তিনি ক্ষেত্রে বিশেষে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, প্রধান প্রতিবেদক, মফস্বল সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদককের মত গুরুত্বপূর্ণ পদের কার্ড দিতে দ্বিধা করেন না সংশ্লিষ্ট সম্পাদকরা। যদিও কিছু কিছু সম্পাদক এর ব্যতিক্রম। অনেক সিনিয়র সাংবাদিকদের মত আমারও মোটামুটি বিকল্প উপার্জনের মাধ্যম আছে আপাতত। বেতনের ধার ধারিনি তখন। এব্যাপারে কেউ কথাও বলেনি। তখন ছোট এবং বড়দের মধ্যে এক ভাললাগা ও ভালবাসার জায়গা ছিল অনুকরণীয়। সিনিয়ররা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। তখন কম্পিউটারের তেমন প্রচলন ছিলনা। প্রত্যেকের হাতে হাতে ল্যাপটপ নেই এখনকার মত। আমি যে পত্রিকায় কাজ করেছি সে পত্রিকায় কম্পিউটারে মাঝে মধ্যে কাজ করতাম। নিজের তখন কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছিলনা। অফিসের যে কম্পিউটারগুলো ছিল ওইগুলোতে কাজ করতাম। কথা হচ্ছে বার্তা সম্পাদক থেকে নতুন কিছু জানব বলে ওনার দেয়া এসাইনমেন্ট নিয়মিত দিতাম। এছাড়াও বিভিন্ন উপজেলা থেকে মোবাইলে কারেন্ট নিউজ দিত প্রতিনিধিরা। তখন প্রতিনিধিদের দেয়া সংবাদটি নোট করে সংবাদটি যখন বার্তা সম্পাদকের হাতে দিতাম তখন তিনি ওই সংবাদটিতে অনেক কিছু নতুনত্ব আনতেন। সবই শেখার ছিল, ইনট্রো, প্রতিটি শব্দ, বাক্য বিন্যাস, বডির বর্ণনাসহ সংবাদটি হয়ে উঠে পাঠক উপযোগি। যতবারই চোখ বুলায় ততবারই কোন না কোন কিছুর পরিবর্তন আসে এবং এটাই একজন ভাল সাংবাদিকের লক্ষণ। পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজন এর সম্মিলন যেন একজন শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টারের জন্য আনন্দের বটে। আর এখন প্রতিনিধিরা যেমন পাঠাই তেমনই ছাপিয়ে দেন কর্তা বাবুরা। এভাবে সাড়ে তিন বছর একটানা শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টার। হাতে একটা কার্ড নেই। অনেকবার বলেছি বার্তা সম্পাদককে একটা কার্ড ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। কারণ কোন সংবাদের জন্য কোন অফিস বা ব্যক্তির কাছে বক্তব্য নিতে গেলে অনেক সময় কার্ডের প্রয়োজন হতো। কিন্তু করার কিছু ছিলনা। মাঝে মধ্যে একটা সংবাদের বাই নেইমে আসত। একটা সংবাদ বাই নেইমে আসলে কি যে ভাল লাগত বুঝার উপায় নেই। সময়ের পরিক্রমায় স্টাফ রিপোর্টার হলাম। বুকে সাহস বাড়লো আর দায়িত্বও বেড়ে গেল। এভাবে শিখতে শিখতে এক পত্রিকা থেকে অন্য পত্রিকা বিভিন্ন পদবী ধারণ করে। বিভিন্ন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, চীফ রিপোর্টার, মফস্বল সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। কয়েকটি অনলাইন পোর্টালকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ার অভিজ্ঞতা নাই বা বললাম। একটা নিউজ পোর্টাল থেকে ৩ মাসের বকেয়া বিল পাবো। সেটা না হয়ে অন্য পত্রিকার মত আল্লাহ বিচার করবেন। আমার পাওনা আমি সেদিনই নিব। সে যাই হোক সবার সাথে অন্তত আন্তরিকতার মোটেও ঘাটটি নেই। যে সব পত্রিকায় কাজ করেছি। দৈনিক সৈকত, বাঁকখালী, আপনকন্ঠ, কক্সবাজার বাণী, জাতীয় দৈনিক আজকের বিনোদন, অনলাইন টিভি এজাহিকাপ, অনলাইন পোর্টালের মধ্যে, স্পোর্টস টাইমস, ফুলেশ্বরী ও বে-বেঙ্গলনিউজসহ দেশ-বিদেশী অনেক গণমাধ্যম। এখন একজন সংবাদকর্মী হিসেবে শিক্ষা নবিশ স্টাফ রিপোর্টারকে স্টাফ রিপোর্টারের কার্ড ধরিয়ে দেয়া হয় যোগদানের প্রথম দিন থেকেই। সাংবাদিকতার ‘স’ সম্পর্কে যার নূন্যতম ধারণা নেই, তাকে যদি স্টাফ রিপোর্টারের মত গুরুত্বপূর্ণ পদটির কার্ড ধরিয়ে দেয়া হয়? তাদের থেকে কি পেতে পারে সমাজ। এই চর্চা এখন কক্সবাজারে মহামারিতে রূপ নিয়েছে। শুধু তাই নয় সাংবাদিকতার বছর না যেতেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদবী সম্বলিত কার্ড দিয়ে বসে থাকেন অসাধু বকলম মার্কা সম্পাদক ও পত্রিকার মালিকপক্ষ। এছাড়া অনলাইন পত্রিকা নামধারী কিছু পোর্টালের সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক নামধারীরা সাংবাদিকতার আরেক বারোটা বাজাচ্ছেন। যদিও কিছু কিছু অনলাইন পোর্টাল কিছুটা নিয়মনীতি ঠিক রেখেই হাঁটছেন। বর্তমানে সাংবাদিকতা সম্পর্কে জানলে গা শিউরে উঠে। তখন এতগুলো পত্রিকা ছিলনা। আপনার আগেই জেনেছেন। সাংবাদিকতার একটি ঘটনা আপনাদের কাছে শেয়ার করি, কক্সবাজার মা ও শিশু হাসপাতাল। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের বিপরীতে যেটি রয়েছে। ওখানে সে সময়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সোমা চৌধুরী ও তাঁর স্বামী এই মুহুর্তে নামটি মনে পড়ছে না। সেও ডাঃ ছিলেন। ডাঃ সোমা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ ছিল। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে রোগির স্বজনদের সাথে অসৌজন্য আচরণ, নরমাল ডেলিভারি না করে সিজার ডেলিভারিতে উদ্ভুদ্ধ করা, (যে চর্চাটা এখনও অনেক ডাক্তার করে যাচ্ছেন), মোটা অংকের টাকা দাবীসহ অনেকগুলো অভিযোগ দীর্ঘদিনের। একদিন ডাক্তার সোমা চৌধুরীর কাছে গেলাম। সংবাদটি জনস্বার্থে করার মানসে। চলবে…

আজাদ মনসুর (এম.এ, এলএল.বি শেষবর্ষ)
আইটি স্পেশালিষ্ট, প্রণেতা-কক্সবাজার সাংবাদিক কোষ, সভাপতি-কক্সবাজার সাংবাদিক সংসদ (সিএসএস)
azadcox90@gmail.com ০১৮৪৫-৬৯ ৫৯ ১৬