শাহেদ মিজান, সিবিএন:

রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যপণ্য সরবরাহে নিয়োজিত সৌদি ভিত্তিক সাহায্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গনাইজেশন (আইআইআরও) ভয়ংকর জালিয়াতিতে জড়িত রয়েছে। শুরু থেকেই সংস্থাটির লোকজন জালিয়াতি করে আসলেও নানা কৌশলে পার পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আর শেষ রক্ষা হলো না তাদের। রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সরবরাহে এই সংস্থাটির জালিয়াতির এবার হাতেনাতে ধরলেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। জালিয়াতির অভিযোগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আবছার সংস্থাটির নিম্নমানের খাদ্যপণ্য জব্দ করেছেন।  শনিবার (২৫ মে) বিকালে খাদ্যপণ্যগুলো জব্দ করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের খাদ্য সরবাহের নিয়োজিত রয়েছে সৌদি ভিত্তিক এনজিও ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গনাইজেশন (আইআইআরও)। সংস্থাটি রোহিঙ্গা আসার পর থেকেই খাদ্যপণ্য সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে। বিভিন্ন সময় এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। সংস্থাটির কক্সবাজারে দায়িত্বরত কয়েকজন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ। তারা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের মাধ্যমের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। নিম্নমানের খাদ্যপণ্য জব্দের পর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সৌদি ভিত্তিক সাহায্য সংস্থা আইআইআরও এফডি-৭ অনুযায়ী সর্বশেষ ধাপে ২২ লাখ ৩৪ হাজার খাদ্যপণ্য সরবাহের অনুমতি চান। যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে প্রশাসন সংস্থাটিকে এসব খাদ্যপণ্য সরবরাহের অনুমোদন দেন। এই ধাপে ১৫৪২ পরিবারের জন্য চালসহ নিত্য পণ্য ও রমজানের পণ্য ছিলো। পণ্যের তালিকায় রয়েছে চাল, গম আটা, মশুর ডাল, তেল, লবণ, ছোলাবুট ও চিনি। অনুমোদন আবেদনপত্রে আইআইআরও যে মানের পণ্য দেখিয়েছে প্যাকেটে দিয়েছে তার চেয়ে অধিক নিম্নমানের পণ্য। যার বাজার মূল্য অনুমোদন মূল্যের প্রায় অর্ধেক।


অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আবছার জানান, নিয়ম মতে রোহিঙ্গাদের জন্য সরবরাহ করা সব ধরণের পণ্য তদারকি করা হয়। সে মতে, আইআইআরও’র অনুমোদন পাওয়া ১৫৪২ প্যাকেট খাদ্যপণ্যও তদারকি করা হয়। এসময় প্যাকেট খুলে দেখা যায়, অনুমোদন আবেদনপত্রে যে মানের পণ্য দেখানো হয় তা প্যাকেটে দেয়া হয়নি। দেয়া হয়েছে অতি নিম্নমানের পণ্য। বিষয়টি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য ওই প্যাকেটের প্রতিটি পণ্য বাজারে গিয়ে যাচাই করা হয়। এতে ধরা পড়ে চরম অনিয়ম। কেননা অনুমোদন আবেদনপত্রে উল্লেখ করা মূল্যের সাথে প্যাকেটে দেয়া পণ্যের বাজারমূল্যের বিরাট ব্যবধান।

তথ্য মতে, আইআইআরও’ অনুমোদন আবেদনপত্রে চালের দাম দেখিয়েছে কেজি প্রতি ৪৫ টাকা। কিন্তু জেলা প্রশাসনের যাচাইয়ে ওই সংস্থার দেয়া চালের বাজার দর পাওয়া গেছে কেজি প্রতি ২৫ টাকা। একইভাবে গম আটার দাম দেখানো হয় ৪০ টাকা কিন্তু প্যাকেটে দেয়া আটার বাজার দর ২৮ টাকা, মশুর ডালের দাম দেখনো হয় ৯৫ টাকা কিন্তু প্যাকেটে দেয়া ডালের মানের বাজার দর ৫০ টাকা, ভোজ্য তেলের দাম দেখানো হয় ১০০ টাকা কিন্তু প্যাকেটে দেয়া তেলের বাজার দর ৬২ টাকা, লবণের দাম দেখানো হয় ৩৩ টাকা কিন্তু প্যাকেটে দেয়া লবণের বাজার দর ১৫ টাকা, ছোলাবুটের দাম দেখানো হয় ৯০ টাকা কিন্তু প্যাকেটে দেয়া ছোলাবুটের বাজার দর ৬৮ টাকা এবং চিনির দাম দেখানো হয় ৬২ টাকা কিন্তু প্যাকেটে দেয়া চিনির বাজার দর ৫১ টাকা।

হিসাব করে দেখা গেছে, আইআইআরও’ প্রতি প্যাকেট খাদ্যপণ্যের দাম দেখায় ১৪৪৯ টাকা। কিন্তু প্রতি প্যাকেটে পণ্য দিয়েছেন মাত্র ৮৮৭ টাকার পণ্য। হিসেবে প্রতি প্যাকেট থেকে ৫৬২ টাকা মেরে দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে ১৫৪২ প্যাকেট থেকে ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা লোপাট করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইআইআরও’র কক্সবাজারে সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন আনোয়ার হোসেন নামে এক কর্মকর্তা। তিনিই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খাদ্যপণ্য সরবরাহের সব ধরণের কার্যক্রমের প্রধান।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে সংস্থাটির উচ্চ পর্যায়ের লোকজনসহ একটি সিন্ডিকেট খাদ্যপণ্য সরবরাহের এই ভয়ংকর জালিয়াতিতে জড়িত রয়েছেন। সিন্ডিকেটটি শুরুর দিকে এভাবে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে। পণ্য সরবরাহের জন্য খোলা টেন্ডার ঘোষণার নিয়ম থাকলেও এই সিন্ডিকেডটি অধিকাংশ প্রকল্প তারা নিজেরাই বাস্তবায়ন করেছে। এভাবে তারা প্রতি প্রকল্প থেকে এক-তৃতীয়াংশের বেশি টাকা মেরে দিয়েছেন। এতে কোটি কোটি তারা লোপাট করেছে সিন্ডিকেটটি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আইআইআরও’র কক্সবাজারের সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এভাবে পণ্য সরবরাহ করে আসছি।’

সার্বিক প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আবছার বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি সংস্থাটির লোকজন সুকৌশলে নিম্নমানের খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে আসছে। এবার হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। প্রমাণ পাওয়ায় সংস্থাটির বেশ কিছু খাদ্যপণ্য জব্দ করা হয়েছে। এর জন্য আরো তদন্ত চলছে। তদন্তে সব অনিয়মের বিষয়টি প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’