উদিসা ইসলাম

একবিংশ শতকে এসে সাংবাদিকতায় পেশাগত অনেক প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হয়েছে। কেউ বলছেন সাংবাদিকতা বদলে যাচ্ছে, কেউ বলছেন, মাধ্যম বদল হলেও সাংবাদিকতা বদলানোর কোনও সুযোগ নেই। আর এসব ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই চলছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে হাজির হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলার প্রস্তুতি সাংবাদিকদের আছে কিনা, সেটিও নজরে নেওয়া জরুরি। একইসঙ্গে পেশাকে ঝুঁকির মুখে না ফেলতে দক্ষ ইউনিয়নসহ বেশকিছু উপাদান সক্রিয় থাকা দরকার বলেও মত দেন তারা।

হুমকি-ধমকি ও হত্যা

সাংবাদিকদের যেমন হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়, তেমন পেশাগত জটিলতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ারও উদাহরণ আছে। আর অনলাইনের যুগে প্রতিষ্ঠান বন্ধের হুমকি থেকে নানা আইনি বেড়াজালে আটকে ফেলার ঘটনাও কম নয়।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী যে ৮০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, তাদের অর্ধেকেরও বেশি টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৭ সালের তুলনায় সাংবাদিক হত্যা বেড়েছে অন্তত ১৫ শতাংশ৷

এর বাইরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৪৮ জন সাংবাদিককে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। ৬০ জন জিম্মি হয়েছেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে৷ প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়৷ ২০১৭ সাল থেকে র‌্যাংকিংয়ে কোনও পরিবর্তন না হলেও রেটিংয়ে কিছুটা অবনতি হয়েছে৷ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬৷ স্কোর ৪৮.৬২৷ ২০১৭ সালে স্কোর ছিল ৪৮.৩৬৷

‘আর্টিকেল নাইন্টিন’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন চলতি মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মত প্রকাশজনিত ১৩১টি ঘটনায় আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। শুধু মত প্রকাশজনিত কারণে মোট ৩১টি ফৌজদারি (মানহানি) মামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ৭১টি মামলা করা হয়েছে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায়। ৯টি বেআইনি আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনাসহ ২০টি বিভিন্ন ধরনের হয়রানিমূলক মামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এ দেশে আধুনিক ধারার সংবাদপত্রের বিকাশ শুরু হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সক্রিয় হওয়ার পর গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু, সজ্জা ও উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা থাকাটা জরুরি। কেননা, আজকে যেটা আকর্ষণ করছে, সেটি কালকেও করবে এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে যেসব ঘটনা শেয়ার হয়, সেগুলোর বেশির ভাগের সত্যতা খুব কম থাকে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করাই ভবিষ্যৎ সাংবাদিকতার প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষও এখন তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে পড়েছে। এসব যোগাযোগ মাধ্যম প্রাথমিক তথ্যের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় সাংবাদিকদের জন্য এটা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়াৎ ফেরদৌস বলেন, ‘মূলধারার সাংবাদিকতা অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। পাঠকের টেস্ট বদলেছে এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্রিটিক্যাল সাংবাদিকতা নেই। ফলে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত।’

স্বাধীন সাংবাদিকতা

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সামনে যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এ পেশার স্বাধীনতা। এই সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত আরও অনেক সমস্যা বলে চিহ্নিত করছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে পাঠক বা দর্শক প্রত্যাখ্যান করে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ প্রভাষ আমীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে এ বছরও বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই। এজন্য সরকারের নানা আইনি প্রতিবন্ধকতা যেমন আছে, তেমনি আছে আমাদের দায়ও। আমরা যতটা না সরকারের ভয়ে, তার চেয়ে বেশি স্বেচ্ছায় নিজেদের কণ্ঠ চেপে রেখেছি।’ স্বেচ্ছায় কীভাবে কণ্ঠরোধ করছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা কিছুটা স্বার্থে, কিছুটা আনুগত্যে।’

সেল্ফ সেন্সরশিপ

নানারকম হয়রানি এড়িয়ে যেতে সাংবাদিকরা যখন সেলফ সেন্সরশিপের আশ্রয় নেন, তখন গণমাধ্যম আর স্বাধীন থাকে না  বলে মত জানান এ পেশার লোকেরা। তারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে সেলফ সেন্সরশিপ অবলম্বন করেন। অনেক সময় চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ বেশি, তাদের বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। কঠোর সম্পদকীয় নীতিমালার মধ্য দিয়ে এই প্রবণতা এড়ানো সম্ভব বলেও মত দেন তারা।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সদ্য বিলুপ্ত ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন একাধিক সাংবাদিক বলেন, মামলা হওয়ার পর নানা সময়ে জটিল বিষয়গুলোতে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে গেলে আগে নিজের বিপদ এড়ানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক সময় অনেক তথ্য জেনেও চুপ করে থাকেন। কেননা, বিপদে পড়লে অফিস বা নেতাদের কাছ থেকে খুব বেশি সমর্থন পাওয়া যায় না।

২০১৭ সালের ১১ জুন বিডিনিউজে ‘একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় গোলাম মুজতবা ধ্রুব’র বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন মানিকগঞ্জের এক বিচারক। এ ঘটনার পরপরই বিভিন্ন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল সাংবাদিক সমাজ। তা সত্ত্বেও এখনও সেই ট্রমা ধ্রুবকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ধ্রুব তখন তার পাশে অনেককে পেলেও নাম প্রকাশ না করে আরেক সাংবাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক সময় আমি দেখেছি, বিপদের সময় অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যায় না। আবার ঘটনাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে রিপোর্টারের ওপর দায় চাপানোর প্রবণতাও আছে। চাকরিটা আমার যখন দরকার, তখন আমি এসব হয়রানি এড়িয়ে যেতে চাইবো এটাই স্বাভাবিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. কাবেরী গায়েন মনে করেন, বাংলাদেশে ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ বিষয়টি কোনও অর্থ বহন করে না। কেননা, বাস্তবতা হলো এখানে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সর্ড। তিনি বলেন, ‘যে গুটিকয়েক সাংবাদিক এই পরিস্থিতির বাইরে থেকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে সাংবাদিকতা করতে চান, তারা নানা হয়রানির শিকার হন। তাদের নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া সেটি তাকে সাহসী হতে বাধা দেয়।’ কেন এই পরিস্থিতি? এমন প্রশ্নের জবাবে কাবেরী গায়েন বলেন, ‘সাংবাদিকতার বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করলে সঠিক সাংবাদিকতা করা যায় না। সাংবাদিকতার সঙ্গে যু্ক্তরা যখন হয় কোনও কিছু প্রত্যাশা করেন, নানা হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়ে যান, তখন তিনি মুক্ত সাংবাদিকতা করতে পারবেন না।’

করপোরেট জামানায় সাংবাদিকতা

সাংবাদিকদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থা ও ‘শুভাকাঙ্ক্ষিরা’ আর্থিকসহ নানাবিধ সহযোগিতা দিয়ে তার কাজে ব্যাঘাত যেমন ঘটান, তেমনই বর্তমান করপোরেট যুগে এসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নানা লেনদেনের হিসাব রেখে গণমাধ্যম টিকে থাকে। এ বাস্তবতায় আসল সাংবাদিকতা করা সম্ভব কিনা প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়াৎ ফেরদৌস বলেন, ‘প্রযুক্তি ও সরকারের সমালোচনা না শোনার যে সংস্কৃতি, এ দুই কারণে সাংবাদিকতা ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিজ্ঞাপন সংস্থার চাপ।’ বাংলাদেশ ক্রান্তিকাল পার করছে উল্লেখ করে তিনি আরও  বলেন, ‘নানাবিধ চাপে এর আগে সাংবাদিকতা এতটা কোনঠাসা হতে দেখিনি।’ অভিজ্ঞ পুরনো সাংবাদিকদের চাকরির ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে রোবায়েৎ ফেরদৌস বলেন, ‘বেশি বেতনের কর্মী রেখে বড় অংকের বেতন দিতে রাজি না প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠানে কে থাকবে কে থাকবে না সেটা বাজার নির্ধারণ করে দেয়। বিজ্ঞাপনের যে বাজার সেই অর্থ দিয়ে টিকে থাকা যাচ্ছে না। আবার, যখন সাংবাদিক সত্যটা বলতে পারবে না, তখনও ইন্ডাস্ট্রি টেকে না। কারণ, পাঠক তখন অন্য কিছু খুঁজে নেয়।’

নেতৃত্বের সংকট ও আইনি প্রতিবন্ধকতা

ভয়ভীতি মাথায় রেখে সাংবাদিকদের কাজ করতে হয় অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে বলে উল্লেখ করেন ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘অযোগ্য নেতাদের কারণে সাংবাদিকরা এই ভয়-ভীতি থেকে নিজেদের বের করতে পারেন না।’

পিন্টু বলেন, ‘চাকরি গেলে বা কোনও চাপের মুখে পড়লে বা প্রতিষ্ঠান পাওনাদি না দিলে, মালিকদের সঙ্গে দেন দরবারের জন্য, বা অধিকার নিশ্চিত করতে গেলে তার পাশে নেতারা আছেন, এই ভরসাটুকু পেলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো।’ একই সঙ্গে হামলা মামলার মাধ্যমেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আর্টিকেল নাইনটিন এর প্রতিবেদন বলছে, ডিজিটাল অ্যাক্টের আওতায় অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সাময়িক বন্ধ বা ব্লক করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। এ ধরনের মোট ৮টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। উদাহরণ হিসেবে দ্য ডেইলি স্টার, এশিয়ান এজ ও বিডিনিউজ ২৪ এর উল্লেখ করা যায়।

অযোগ্য সাংবাদিক নেতাদের সহযোগিতা না পাওয়ায় সাংবাদিকরা অফিসের ভেতরে ও বাইরে ভয় নিয়ে চাকরি করেন এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক নেতা সোহেল হায়দার চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত দেড়-দুবছরের ইউনিয়নের দিকে তাকালে অনেক জায়গায় সফল হতে দেখেছি। কর্মরত যারা ছিলেন তাদের ঐক্যের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। যেকোনও সংকট উত্তরণের জন্য ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই, তা আমরা যে ফোরামেরই হই না কেন।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনও সাংবাদিক, তিনি ইউনিয়নের সদস্য নাও হতে পারেন,আমাদের কাছে এলে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি। নেতৃত্বের অযোগ্যতা বলতে কী বুঝিয়েছেন জানি না, আমরা যখন সমস্যা-সংকটের জন্য সবাইকে ডাকি, তখন যে সহযোগিতা পাওয়া দরকার সেটি পাই না। যেটি আমাদের অস্ত্র হতে পারতো। সুযোগ পেলে ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকলে ইউনিয়নের শক্তি বাড়ে।’

 

সুত্র- বাংলা ট্রিবিউন