এম এ সাত্তার

৬৫ দিনের জন্য সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগামী ২০ মে থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হলেও ইতিমধ্যে শত শত নৌকা তীরে ফিরে এসেছে। অন্যরাও সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মাছ ধরা বন্ধ হওয়ায় কক্সবাজার জেলার লাখ লাখ জেলে পরিবার এখন শঙ্কায় পড়েছে। আর প্রত্যেক জেলে পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করবে।

এখন চলছে পবিত্র রমজান মাস। আর সামান্য কদিন পরই ঈদ। এই সময়ে অনেক পরিবারের নতুন জমা কাপড় কেনাসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। এই রোজা ঈদ সামনে নিয়ে প্রতি পরিবারে অনেক টাকা প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই সময়ে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেলে বাড়ীর একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকটি বেকার হয়ে পড়বে। তার পাশাপাশি ওই জেলে পরিবারে কেনাকাটাতো দুর কথা, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে। আর ঈদকে সামনে রেখে কেনাকাটা করতে না পারলে প্রতি জেলে পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কান্না থামানো দায় হয়ে পড়বে। যদিও সরকার একান্তই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে তবে ঈদ পরর্বতী যে কোন সময়ে দেয়ার জন্য প্রত্যেক জেলে পরিবারের সদস্যরা জোরদাবী জানিয়েছেন। অন্য দিকে ইলিশের মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণাকে অযৌক্তিক দাবি করে তা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জেলা ও বোট মালিকদের সংগঠনের নেতারা।জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে আগামী ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
কক্সবাজার ফিশারীঘাট এলাকায় নদীর তীরে দেখা যায়, মৎস্য অবতরণকেন্দ্র ঘিরে শত শত মাছ ধরার নৌকা নোঙর করে রয়েছে। সাগরের মোহনা, নদীর তীরে জেলেদের কেউ কেউ অলস বসে রয়েছেন। কেউ নৌকা-জাল বুনছেন। কেউবা খোশ-গল্প মেতে রয়েছেন।
মৎস্য অফিস সুত্রে জানা যায়, বর্তমান এই সময়ে সাগরে মাছ প্রজনন এর ভরা মৌসুম। তাই মাছের প্রজনন মৌসুমে বঙ্গোপ সাগরে সকল ধরনের মাছ ধরার নৌকা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মিয়ানমার ও ভারত একইভাবে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে বলেও জানা গেছে। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলার সাগর উপকূলীয় এলাকায় শতশত নৌযান ইতিমধ্যে তীরে ভিড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল ফিশারীঘাট নুনিয়ারছড়া, মাঝেরঘাট, খুরুস্কুল জাইল্লাপাড়া, নাজিরারটেক, চৌফলন্ডী, কুতুবদিয়া পাড়া, টেকনাফ, শাহপরীরদ্বীপ, চকরিয়ার বদরখালী।মহেশখালীর গোরকঘাটা, ঘটিভাঙ্গা,তাজিয়া কাটা, চরপাড়া, জাইল্লাপাড়া, ধলঘাটা, সোনদিয়া, মাতারবাড়ী ও কুতুবদিয়ার লাখ লাখ জেলে বেকার হয়ে যাচ্ছেন। এক টানা ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় পরিবারের ভরণ পোষণ নিয়ে শঙ্কায়ও রয়েছে তারা।

মাছ ধরা বন্ধ রাখার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জমির উদ্দিন নামে এক মাঝি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা জাইল্লা। আমাদের পেশা মাছ ধরা। আমাদের জীবনের কোন গ্যারান্টি নেই। এই জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাই। কিন্তু জীবন নিয়ে ফিরে আসার মত কোন আশা আমাদের থাকেনা। একটানা ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকলে জেলেদের পরিবারে চরম দুর্দশা নেমে আসবে।

খুরুস্কুল এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ এনামুল হক সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, নদী সাগর বলে কথা। এগুলো ব্যবহারেও তো একটি লিমিট থাকা দরকার। জেলেরা সময়ে অসমে সাগর নদীতে অবাধ বিচরণ করে মাছের খাদ্য জাতীয় উপকারি পোঁকামাকড়, কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে মাছসহ যে আকারে অন্যজাতীয় প্রাণী জালে আসবে তা ধরে নিয়ে আনছে। বিগত যুগযুগ ধরে এভাবে জেলেরা হাজার হাজার প্রা্ণীকুল মেরে ফেলছে। ইতিমধ্যে অনেক প্রকার মাছের বংশ বিলোপ হয়ে গেছে। এভাবে জেলেরা সারা বছর খাল, নদী, সাগরে মাছ ধরার নামে প্রকৃতিক প্রানী মেরে ফেলছে। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন সরকারের আরো কয়েক যুগ আগে থেকে সাগরের মাছসহ অসংখ্যা প্রাণীকূল রক্ষার জন্য এরকম জরুরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। সারা বছর নদী সাগর এভাবে অরক্ষিত রাখলে আর কয়েক বছরের মধ্যে শুধু মাছ নয় অন্য পেঁকামাকড়ও বিলুপ্তি হয়ে যাবে। তাই এই বছর থেকে প্রতি বছর এর ধারাবাহিকতা চলমান রাখার পক্ষে দাবি তোলেন সে। কিছু দিন মাছ আহরণ বন্ধ রাখলে এ সুফল সম্পর্কে যুক্তির পক্ষে জানান প্রতি বছর কয়েক মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকার পরে যে কয়েক মাস জেলেরা সাগর থেকে মাছ ধরবে ওই সময়ে পুরো বছর মাছ ধরার চাইতে অধিক ইনকাম করতে পারবে।
অন্যদিকে সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রেখে উপকূলীয় জেলে পরিবারের জীবনমানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এই সময়ে সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে সাবেক একজন প্রতিনিধি বলেন, সারাদেশে ৪৭ হাজার মাছ ধরার বোট রয়েছে। এক কোটি মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকলে এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় প্রভাব পড়বে।
শহরের কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা বোট মাঝি মো.সৈয়দুল কাদের, আমিনুল ইসলাম, আবুল কালাম বলেন, মাছ ধরা বন্ধ থাকলে জেলেদের জীবিকাও বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে অনেক জেলে জীবন-জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েন।কয়েকজন জেলের সাথে কথা বল্লে তারা জানান, সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে জেলে ও মাঝি-মাল্লারা বেকার হয়ে পড়েছেন। দুই মাসের বেশি সময় বেকার বসে খাওয়ার মতো সামর্থ্য জেলে পরিবারের থাকে না। এসময় বাধ্য হয়ে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়। সরকার মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও এই সুফল এদেশের জেলেরা ভোগ করতে পারবে কিনা? এ ব্যাপারে জেলেদের মধ্যে নিধারুন সন্দিহান রয়েছে বলে জানা গেছে। এর সুফল এদেশের মানুষ ভোগ করতে পারবে না বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পাশের দেশ ভারতের জেলেদের কিন্তু সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে না। আমাদের দেশের অবরোধের সুবিধাটা তারাই ভোগ করবে। এমনিতেই তারা বঙ্গোপসাগরে আমাদের জলসীমায় অবৈধভাবে প্রবশে করে সারা বছরই মৎস্য আহরণ করছে। আর এই অবরোধের সুযোগে ভারতীয় জেলেরা অত্যাধুনিক ফিশিং ট্রলার দিয়ে আমাদের ইলিশ ছেঁকে নিয়ে যাবে তা কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব হবে না। তাই জেলে সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার কথা ভেবে সরকারকে বিষয়টি পুনঃ বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছে তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহেশখালীর এক বহদ্দার বলেন, বোট মাঝি-জেলে ছাড়াও এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বোটের মালিক, আড়তদার, ঘাট শ্রমিক, ব্যবসায়ী, ঠেলা-ভ্যান চালকেরাসহ আরো অনেক মানুষ এ কাজের প্রতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পরিবার পরিজনের ভরন পোষণ করে আসছে। তাই দীর্ঘ দিন মাছধরা বন্ধ থাকলে লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ বেকার হয়ে যাবে। যার কারণে এদের পরিবারের ভরণ-পোষণ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। তাই জরুরী ভিক্তিতে মৎস্যজীবিদেরকে আর্থিকভাবে সহযোগীতা করার জন্য জোরদাবি জানান তারা।