সিবিএন ডেস্ক:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৭৩ হাজার শিশু অগ্নি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তনে শিশুদের প্রতি সচেতন হওয়ার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। শিশুদের অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে সচেতনতা প্রয়োজন উল্লেখ করে চিকৎসকরা মা’দের রান্নার সময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। গরম পানি, চা, কফি, স্যুপ, ডাল এগুলো শিশুদের নাগালের বাইরে রাখার কথা বলছেন।

শিশু নক্ষত্র-এর বয়স ৪ বছর। তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে বাবা মামুন রশীদ। ছেলের হাত এখন অনেক ভালো কিন্তু তার হাতে থাকা দাগ যেন পুরোপুরি উঠে যায় সেটা নিয়েই বাবার চিন্তা। আরেক শিশু তাসনিম সিদ্দিকী (৪) ঢামেক বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি। শরীরের ৮০ ভাগ গরম পানিতে পুড়ে গেছে। তার দাদি হুমায়রা বেগম বলেন, নাতি খেলতে গিয়ে গরম পানির মধ্যে পড়েছে। শুধু নক্ষত্র কিংবা তাসনিম নয়, ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের শিশু ওয়ার্ড ভর্তি পুড়ে যাওয়া শিশুতে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য অনুযায়ী, স্বল্প ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রতিবছর এক লাখ ৮০ হাজার মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ এবং ইথিওপিয়ায় ৮০-৯০ ভাগ আগুনে পোড়ার ঘটনা নিজ বাড়িতে ঘটে। শিশুরা নিজ বাড়িতেই সবচেয়ে বেশি অগ্নি দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিশ্বে শিশু মৃত্যুর পঞ্চম কারণ হচ্ছে অগ্নি দুর্ঘটনা।

শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গরম পানি ও গরম ডালের কারণে শিশুরা সবচেয়ে বেশি পুড়ে যায়। মা অসচেতন হয়ে রান্না করে তখন শিশু চুলার কাছে এলে পুড়ে যায়। আবার ছোট ছোট কাজের ছেলে-মেয়েরা গরম পানি বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় শরীরে পানি পড়ে পুড়ে যায়। এছাড়া ইলেকট্রিকের কোনও সুইচ হাতের নাগালে থাকলে শিশুরা সেখানে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে পারে। এতে তারা বিদ্যুতায়িত হয়ে পুড়ে যায়।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ‘শিশুরা সবচেয়ে বেশি পোড়ে গরম পানি, গরম খাবার অথবা গরম তরল পদার্থ যেমন -চা, কফি, স্যুপ, গরম ডাল ও গরম পানিতে। ইলেকট্রিক বার্নের শিশুও আমরা পাই। এখন ইলেকট্রনিক পণ্য ঘরে ঘরে বেড়ে গেছে। দেখা গেল ফ্যান রেখেছে সেটার তার একদিকে কাটা। সেখানে কোনও শিশু হাত দিচ্ছে। এরপর রয়েছে গরম কোনও জিনিসের ওপর পড়ে যাওয়া। গ্রামাঞ্চলে যেটা হয় ধান মাড়াইয়ের চাতালে যে চুলার ছাই পড়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে আগুন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শিশুরা খেলতে গিয়ে ওই ছাইয়ের ভেতর পা চলে যায়। তখন পুরো পা পুড়ে যায়। এই পোড়াগুলো খুবই কষ্টকর হয়।’

নক্ষত্র-এর বাবা মামুন রশীদ বলেন, ‘আমি তখন অফিসে ছিলাম। ওর মা ওয়াশরুমে ছিল। আমার ছেলে পাতিল নিয়ে খেলার জন্য গরম পানিসহ পাতিলটা ধরেছে। এর ফলে ওর ডান হাত পুড়ে গেছে।’

শিশুদের পুড়ে যাওয়ার কারণে ক্ষতি প্রসঙ্গে ডা. তানভির আহমেদ বলেন, ‘শিশুদের ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) কম। এছাড়া শিশুদের শরীরে পানির রিজার্ভ ও গ্লুকোজ বা ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। ২০ ভাগের উপর বার্ন হলে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা খুব কঠিন হয়ে যায়।’

শিশুদের অগ্নি দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে সচেতনতা প্রয়োজন উল্লেখ করে ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, ‘আমি পরামর্শ দেই মায়েদের- তারা যখন রান্না করবেন তখন যেন সাবধানে থাকেন। রান্না করবেন এমন জায়গায় যাতে শিশুরা নাগাল না পায়। গরম পানি, ডাল এগুলো যেন শিশুদের নাগালের বাইরে থাকে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও কাপড় ইস্ত্রি করার সময় গরম ইস্ত্রি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ১০ ভাগ পুড়ে যাওয়া শিশুরা সুস্থ হয়। কিন্তু এর বেশি পুড়লে তাদের বাঁচানো যায় না। আগুনে পোড়া অনেক শিশুই আমাদের এখানে চিকিৎসা নিতে আসার পর মৃত্যুবরণ করে।

ডা. তানভির আহমেদ বলেন, ‘অসচেতনতা থেকে শিশুরা পুড়ে যায় বেশি। ঘরে ছোট শিশু আছে তারপরও বেশিরভাগ বাড়িতে চুলা নিচে। এখন শহরের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে চুলা উপরে রাখা হচ্ছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এই হার এখনও অনেক কম। তারা মাটির চুলায়, এমনকি গ্যাসের চুলাও নিচে রেখে রান্না করে। চুলার পাশেই রান্না শেষে গরম পানি, গরম খাবার রেখে দেয়। শিশুটি যখন চুলার কাছে আসে তখন সেই গরম পাতিলটা ধরতে যায়। এ সময় শিশু ডেকচির ভেতরে পড়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ঘরে ২-৩ বছরের ছোট শিশু থাকলে গরম পাতিলগুলো শিশুর নাগালের বাইরে রাখা দরকার। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে রান্নার কড়াই। কড়াইয়ের তলাটা কেমন গোল। এটা ধরলেই পড়ে যায়। কড়াই ব্যবহার না করে ডেকচি ব্যবহার করা উচিত। গরম পানি বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই সেটা পাতিলে না নিয়ে বালতিতে নিয়ে যেতে হবে। এমনও দেখা গেছে বাবা বিছানায় বসে কফি খাচ্ছেন, শিশু হামাগুড়ি দিয়ে এসে বাবাকে ধরতে গেছে। এতে কাপের কফি পড়ে শিশু পুড়ে গেছে।

ডা. তানভীর বলেন, এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেভাবে গণমাধ্যমসহ সচেতন সমাজ সচেতন থেকে এটাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে, একইভাবে শিশুর আগুনে পোড়ারোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম দরকার। এছাড়া এই ধরনের পুড়ে যাওয়া রোধ করা সম্ভব নয়।