মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

প্রতিবছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার জাতীয় মা দিবস। এবারের মা দিবসে একজন রত্নগর্ভা মা’কে নিয়ে লেখা এগল্প।

মর্জিয়া বেগম। পিতার নাম- মাস্টার গোলাম কাদের, মাতার নাম-নাজমুন্নাহার। পিতা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক। মাস্টার গোলাম কাদের স্থানীয়ভাবে সবার কাছে একজন আদর্শ ও অনুকরণীয় শিক্ষক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমান পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের সোনাইছড়ি গ্রামের ১৯৫০ সালে মর্জিয়া বেগমের জম্ম। ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে মর্জিয়া বেগম দ্বিতীয়। স্থানীয় মক্তব, প্রাইমারি স্কুলেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পারিবারিক সংরক্ষণশীলতার কারণে লেখাপড়া আর বেশীদূর এগোয়নি। কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিলের মাওলানা আবদুর রশিদ ও আবিদা খাতুনের পুত্র মোহাম্মদ আবু তাহের কুতুবী’র সাথে বিয়ে হয় ১৯৬৭ সালে। মর্জিয়া বেগম একজন পর্যুদস্ত গৃহীনি। মোহাম্মদ আবু তাহের কতুবী ছিলেন তৎকালীন ইংলিশ মিডিয়ামে এইসএসসি পাশ। তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব শাখার একজন কর্মচারী ছিলেন তিনি। সেসময় তহশীলদার পদ ও বর্তমানে উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা পদের একজন চাকুরীজীবী। চাকুরীর সুবাধে কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ রুমালিয়ার ছরাস্থ এবিসি ঘোনায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। সেখানেই তাহের-মর্জিয়া দম্পতির ৩ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জম্ম। সরকারি চাকুরীর সহজাত নিয়মে মোহাম্মদ আবু তাহের কুতুবীকে জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসেই প্রায় সময় থাকতে হতো। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল নাথাকায় তিনি চাকুরীস্থলেই নিয়মিত থাকতেন। ছোট্ট একটি সরকারি চাকুরী করেই তাঁর সহধর্মিনী মর্জিয়া বেগমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁদের ৪ সন্তান আজ দেশে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। মর্জিয়া বেগম তাঁর আদর্শ শিক্ষক পিতার অনুপ্রেরণায় সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রানান্ত প্রচেষ্টা আর প্রত্যয় ছিল খুববেশী। মর্জিয়া বেগম প্রমাণ করেছেন-ক্ষমতা আর বিত্ত নয়, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, স্বপ্ন আর টার্গেটে পৌঁছার দৃঢ় মনোবল-মানুষকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। মনের দৈন্যতা নয়, মনের বিশালতাই মানুষকে সত্যিকার অর্থে বড় করে তোলে। তাহের-মর্জিয়া দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তানের নাম মোহাম্মদ সাইফুল আরীফ। ১৯৮৫ সালে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি, ১৯৮৭ সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও একই কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে গ্রেজুয়েশন করেছেন। পরে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়র অধীনে এলএলবি করেছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক একটি বেসরকারি সংস্থায় একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্বপালন করছেন। মোহাম্মদ সাইফুল আরীফ বিয়ে করেছেন রহিমা বেগমকে। সাইফুল-রহিমা দম্পতির জ্যেষ্ঠ কন্যা ইসরাত আরীফ সুমাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সম্মান শেষবর্ষের ছাত্রী, দ্বিতীয় কন্যা নুসরাত আরীফ সামিয়া এইচএসসি পড়ুয়া, শাহরিয়ার আরীফ সামিদ তিন বছরের শিশু সন্তান।
তাহের-মর্জিয়া দম্পতির দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ শফিউল আরীফ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে সম্মান সহ মাষ্টার্স করেছেন কৃতিত্বের সাথে ১৯তম ব্যাচে ১৯৯৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ হতেই মোহাম্মদ শফিউল আরীফ দেশের অভিজাত ও মর্যাদাপূর্ণ ক্যাডার হিসাবে পরিচিত ১৯৯৯ সালে ১৮ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিসিএস (প্রশাসন) এ যোগ দেন। চাকুরীর শুরুতেই চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনে সহকারী কমিশনার হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। এরপর চৌদ্দগ্রাম ও লাকসামে সহকারি কমিশনার (ভূমি) হিসাবে সফলতার সাথে কাজ করেছেন। পটিয়া, মহালছড়ি, কাপ্তাই এর ইউএনও, খাগড়াছড়ি সিনিয়র সহকারি সচিব এবং ফেনী জেলা প্রশাসনের এডিসি, ফেনীর ডিডিএলজি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আইন কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের উপসচিব ও ২০১৭ সালের ৯ আগষ্ট হতে অদ্যাবধি লালামনিরহাট জেলার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বপালন করে আসছেন সফলভাবে। মোহাম্মদ শফিউল আরীফ জনপ্রশাসন বিষয়ে লন্ডনের বিখ্যাত ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্লোবালাইজেশন এন্ড গভর্নেন্স বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীও অর্জন করেছেন। মোহাম্মদ শফিউল আরীফ দক্ষ প্রশাসক ও জনবান্ধব কর্মকর্তা হিসাবে সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার পেয়েছেন অনেক। মোহাম্মদ শফিউল আরীফ বিয়ে করেছেন কক্সবাজার শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওমর সুলতান এর জ্যেষ্ঠ কন্যা শাহীন আক্তারকে। শফিউল-শাহীন দম্পতির একমাত্র পুত্র সাদমান আরীফ সিয়াম লালামনিরহাট সরকারি হাই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তাহের-মর্জিয়া দম্পতি’র তৃতীয় পুত্র মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ ১৯৯১ সালে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে প্রথম বিভাগে এসএসসি, ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে প্রথম বিভাগে এইচএসসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ফরেস্ট্রী বিষয়ে ১৬ তম ব্যাচে সম্মান সহ মাস্টার্স করেছেন প্রথম বিভাগে। এরপর ২৪ তম বিসিএস (প্রশাসন)-এ উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকুরীতে যশোর জেলা প্রশাসনে সহকারি কমিশনার হিসাবে যোগ দেন। পরে যশোর সদর উপজেলা ও পটিয়া উপজেলায় সহকারি কমিশনার (ভূমি) হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার ইউএনও হিসাবে দীর্ঘ পাঁচ বছর সফলতার সাথে দায়িত্বপালন করেছেন। পরে চট্টগ্রাম বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসাবে বছর খানেক দায়িত্ব পালন করেন। মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুআরি বাংলাদেশ সরকারের উপ সচিব হিসাবে পদোন্নতি পান। মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। মোহাম্মদ সাঈদুল আরীফ বিয়ে করছেন পেকুয়ার মরহুম আবদুল মালেক ও মুজনে আরা বেগমের কন্যা রেশমিন জান্নাতকে। রেশমিন জান্নাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেছেন। রেশমিন জান্নাত বর্তমানে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক। সাঈদুল-রেশমীন দম্পতির আদিয়াত আরীফ আদিবা ও মাশিয়াত আরীফ মাহিবা নামক দু’কন্যা সন্তানের জনক ও জননী। তাহের-মর্জিয়া দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান আনিচুল আরিফা মুন্নী। কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় হতে ১৯৯৪ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি, কক্সবাজার সরকারি কলেজ হতে ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিবিএ হিসাববিজ্ঞান এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিষয়ে সম্মান সহ মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন ৩৩ তম ব্যাচে। আনিচুল আরিফা মুন্নী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচালনাধীন চট্টগ্রাম হালিশহর আর্টিলারি সেন্টার এন্ড স্কুলের গার্নাস ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক হিসাবে ২০১০ সাল থেকে অদ্যাবধি কর্মরত রয়েছেন। আনিচুল আরিফা মুন্নী বিয়ে করেছেন ঢাকা ইপিজেড-এ হংকং ভিত্তিক বিখ্যাত কোম্পানি হকলোন এর এইচআর ডিভিশনের হেড অব চীফ সাজ্জাদ আহমেদ খানকে। সাজ্জাদ আহমেদ খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিবিএ হিসাববিজ্ঞান এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম- বিষয়ে সম্মান সহ মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়েছেন ৩২ তম ব্যাচে। মুন্নী-সাজ্জাদ দম্পতির সানজিদ আহমেদ খান ও নাদিফা মেহজাবিন খান নামক দু’সন্তানের মাতা-পিতা।
এভাবেই রত্নগর্ভা মর্জিয়া বেগম হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহীনি হয়েও তাঁর ৪ সন্তানকে গড়ে তুলেছেন দেশের আদর্শ, চরিত্রবান ও সুপ্রতিষ্ঠিত নাগরিক হিসাবে। মোহাম্মদ আবু তাহের কুতুবী সফল পিতা হিসাবে এবং মর্জিয়া বেগম রত্নাগর্ভা মাতা হিসাবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। সম্মাননা পদক পেয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে। সফল পিতা মোহাম্মদ আবু তাহের কুতুবী সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। গর্বিত সন্তানদের রত্নাগর্ভা মাতা মর্জিয়া বেগমের প্রতি জাতীয় মা দিবস ২০১৯-এ জানাই গভীর শ্রদ্ধান্ঞ্জলি।
(লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।)