– মাহ্ফুজুল হক

মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ সোবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে করজোড়ে, অবনত মস্তকে ও কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি নিজেদের উপর কৃত স্বীয় যুলুমের জন্য। মিনতি করছি নিজেদের যুলুমের কারণে আমাদের উপর যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তা থেকে নিস্তার পাবার। তিনি যদি ক্ষমা না করেন এবং মেহেরবাণী না করেন তাহলে আমরা চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবো আর চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো।

কোন ব্যক্তি বা সমষ্টি যখন এমন অবস্থায় পতিত হন যে, সে অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি বা তারা পুরোপুরি অক্ষম এবং অপরের সাহায্য সহযোগিতার মুখাপেক্ষী, তেমনি অবস্থা বা পরিস্থিতিকে দুর্যোগ (ডিজাস্টার) বলা হয়ে থাকে। যেমন, সাঁতার না জানা এক ব্যক্তি হাত তোলা বা ততোধিক গভীর পানিতে পড়ে গেলেন। তিনি সেখান থেকে অপরের সহায়তা ছাড়া কোনভাবেই কূলে উঠে আসতে সক্ষম নন। এহেন পরিস্থিতি ওই ব্যক্তির জন্য ডিজাস্টার বা দুর্যোগ। এমনিভাবে, এক বিরাট জনপদ যখন বন্যা, খরা, তুফান, ভূমিকম্প, ভূমিধস, তুষারপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মহামারী প্রভৃতি ব্যাপক বিধ্বংসী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন সেখানকার মানুষ বা প্রাণী ভয়াবহ দুর্যোগ কবলিত বলে গন্য হয়। ইংরেজিতে ডিজাস্টার এর পাশাপাশি ক্যালামিটি নামে অপর একটি শব্দও প্রায় সমার্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। পুঁথি পাঠে জানা যায়, ডিজাস্টার বা দুর্যোগ দু’ধরণের : প্রাকৃতিক (ন্যাচারাল) ও মানবসৃষ্ট (ম্যানমেইড)। বলা হয়ে থাকে, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর যুদ্ধ বিগ্রহ, অভিবাসী হওয়া বা অভিবাসী বিতাড়ন, উদ্বাস্তু, অগ্নিকান্ড ইত্যাদি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এখন প্রশ্ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে আদৌ কি কিছু আছে? এখানে ‘প্রকৃতি’ (ন্যাচার) বলে কার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে?

চলুন একটু অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাই। ‘গ্রীণ হাউস ইফেক্ট’ হালে খুবই আলোচিত একটি বিষয়। নার্সারীতে চারাগাছ, সবুজ শাক-সব্জি উৎপাদনের জন্যই সাধারনতঃ এই গ্রীণ হাউসটির প্রচলন হয়েছে বিশেষভাবে শীতপ্রধান দেশে। সেটি একটি কাচের বা প্লাস্টিকের ঘর যেখানে চারাগাছের সঠিক পরিচর্যার জন্য আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় রাখা হয়। সেই কাচের বা প্লাস্টিকের ঘরে যদি কোন কারণে ফুটো হয় বা কাচ বা প্লাস্টিক ভেঙ্গে যায় অথবা ভিতরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে চারাগাছগুলোর উপর এর মারাতœক প্রতিক্রিয়া হয় এবং সময় মতো ব্যবস্থা নেয়া না হলে এক পর্যায়ে চারাগাছ মারা যায় বা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। আমাদের এই পৃথিবী অনেকটা গ্রীণ হাউসের মতো। পৃথিবীর চারিদিকে বায়ুমন্ডলের এক বলয় রয়েছে যা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের বায়ুর স্তর (লেয়ারস অব এয়ার অর এটমোসফেয়ার)। তারই একটি স্তরের নাম ‘ওজোন স্তর’ বা ‘ওজোন লেয়ার’ যেটি কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। এটি সূর্যের তাপ পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয় না। ফলে সূর্যের তাপে পৃথিবী গরম হয়। কিন্তু এটি উত্তপ্ত পৃথিবী থেকে তাপকে বাইরে চলে যেতে বাধা দেয়। এর ফল স্বরূপ পৃথিবী রাতের বেলা অতিরিক্ত ঠান্ডা হওয়া থেকে রক্ষা পায়। সূর্য হচ্ছে এক বিশাল জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডলী যেখান থেকে প্রতিনিয়ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে অসংখ্য সব মারাতœক গ্যাস, রশ্মি। তারই একটি রশ্মির নাম ‘অতি বেগুনি রশ্মি’ (আল্ট্রা ভায়োলেট রে)। গ্রীণ হাউসের কাচ বা প্লাস্টিক যেমন মাত্রাতিরিক্ত আলো-তাপ, ঝড়-বৃষ্টি, ঠান্ডা-বরফ ইত্যাদি থেকে চারাগাছকে সুরক্ষা দেয়, তদ্রূপ বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরও আমাদের এই পৃথিবীকে সূর্যের ওই বিধ্বংসী ‘অতি বেগুনি রশ্মি’ থেকে বাঁচিয়ে রাখে মানে তা ওই রশ্মিকে নিজের মধ্যে চুষে নেয় এবং একপর্যায়ে তাকে জীবন রক্ষাকারী গ্যাস অক্সিজেনে রূপান্তরিত করে। বিজ্ঞানীরা খবর দিয়েছেন, ইতোমধ্যেই ওই ওজোন স্তরে অনেকগুলো ফুটো সৃষ্টি হয়েছে এবং সে ফুটোগুলো তৈরির পেছনে আমরা মানুষরাই দায়ী। আমরা প্রতিনিয়ত যে সকল গ্যাস আমাদের এসি, মশা মারার স্প্রে প্রভৃতিতে ব্যবহার করছি, কল-কারখানার মাধ্যমে অতিমাত্রায় যে কার্বন নিঃসরন ঘটাচ্ছি, জ্বালানী পোড়াচ্ছি, গাছ-পালা, বন-বাদাড় উজাড় করছি তা ওই স্তরে থাকা কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ সাংঘাতিকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে গ্যাস পৃথিবীকে রাত্রিবেলা গরম রাখতে সহায়ক সেই কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার কারণে তা সূর্যের কাছ থেকে আসা তাপ অতিরিক্ত মাত্রায় ধরে রাখছে এবং পৃথিবী দিন দিন গরম হচ্ছে (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) অতিমাত্রায়। অর্থাৎ কার্বন ডাইঅক্সাইডের অতিরিক্ত উপস্থিতি ওজোন স্তরের কার্যকারিতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। আর সেই ফুটো দিয়ে অবিরাম ধেয়ে আসছে জীবন ও পরিবেশ সংহারী সব রশ্মি।

আমরা ইদানীং ‘জলবায়ু পরিবর্তনের’ (ক্লাইমেট চেঞ্জ) কথা বেশ জোরে শোরেই শুনছি। আর সেই ‘জলবায়ু পরিবর্তনের’ মূল নিয়ামক হচ্ছে ওই ‘অতি বেগুনি রশ্মি’। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) ফলে মেরু অঞ্চল ও পর্বতের চূড়ায় থাকা বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে তাপমাত্রা ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে থাকলে উপকূলীয় অঞ্চল সাগর তলে ডুবে যাবে, সাগর থেকে নদীতে নোনা পানি ঢুকে পড়বে।

অতি সংক্ষেপে যদি বলি, সাধারনতঃ সাইক্লোন তৈরি হয় সাগরের তাপমাত্রা ২৭ক্ক সেলসিয়াস এর বেশি হলে। গভীর সমুদ্রে উচ্চ তাপমাত্রার ফলে বাতাসের জলীয় অংশ শুকিয়ে যায়। শুষ্ক বাতাস হালকা বলে উর্ধ্বমুখী হয় আর সে খালিস্থান পূরণ করতে আশপাশের ভারী বাতাস প্রবল বেগে সেদিকে ধাবিত হয় এবং তথায় বাড়তি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হয়। তখন অক্ষ বরাবর পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির প্রভাবে উত্তপ্ত বায়ু ঘুরতে ঘুরতে উপর দিকে উঠতে থাকে। এই যে, ভারী বাতাসের তীব্র গতিতে নি¤œমুখী হওয়া, হালকা বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী হওয়া ইত্যাদির ফলে বিশাল এলাকা জুড়ে বায়ুমন্ডলে চাপ ও তাপমাত্রার অস্থিতিশীল এক অবস্থা তৈরি হয়। আর তখনই নি¤œচাপটি কেন্দ্রমুখী হয় এবং চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা বায়ু চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। এ অবস্থাটিই হলো ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন। আবার সাইক্লোনের আরেকটি মারাতœক দিক হলো জলোচ্ছ্বাস। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি জনিত কারণে বন্যা এবং অপরাপর দুর্যোগও ঘটে যার বিবরণ এই ছোট্ট পরিসরে দেয়া সম্ভব হলো না।

প্রকৃতপক্ষে মহাপ্রভূ আল্লাহ্ তায়ালার সমগ্র সৃষ্টি এক সুপরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ ম্যাকানিজম। এখানে সামান্যতমও ত্রুটি নাই। তিনি এতো সুদক্ষ ও বিজ্ঞ স্রষ্টা যে, সৃষ্টি কার্যে যেমন তাঁকে চিন্তা-ভাবনা করতে হয় না (কুন ফায়াকু-ন) তদ্রুপ সৃষ্টি করার পর তার পরিচর্যায়ও তাঁকে লেগে থাকতে হয় না। সৃষ্টির সাথে সাথে এমন ম্যাকানিজম তিনি সেখানে দিয়ে রাখেন যে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুচারুরূপে কাজ চালিয়ে যায় রক্ষণাবেক্ষণসহ (মেইনটেনেন্স এন্ড ট্রাবল শুটিং)। ‘মাত্রই ভুল করা’ মানুষের পক্ষে যদি নিখুঁত যন্ত্রপাতি তৈরি সম্ভব হয় তবে মহান স্রষ্টার পক্ষে তা কি অসম্ভব? মানুষ তার অপকর্মের দ্বারা মহান স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মে যখন বিঘœ ঘটায় তখন ঠিক ততটুকুন পরিমান বিঘœ প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রকাশ পায় (এভরি একশন হেজ ইট্স অপজিট রিএকশন)। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ওজোন স্তরের (পরিবেশের) ভারসাম্য রক্ষার জন্য তিনি দিয়ে রেখেছেন পর্যাপ্ত পরিমাণ গাছ-পালা ও বন-বাদাড়। মানুষ যখন তা কেটে উজাড় করে তখন ওজোন স্তরের কল-কব্জার এক বা একাধিক স্ক্রু (ভারসাম্য) নড়বড়ে হতে হতে একসময় খসে পড়ে। এবং তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যে যে বিপর্যয় যে যে পরিমাণে হওয়ার কথা ঠিক তাই ঘটে। এর জন্য মহাপ্রভূকে বিশেষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। এটা এক স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটিক সিস্টেম) ব্যবস্থা। সুতরাং দুর্যোগ প্রাকৃতিক বলে প্রকারান্তরে মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তায়ালার দিকে ইঙ্গিত করার কোন সুযোগই নেই। অবশ্য স্রষ্টার ডিসক্রিশন তো সব সময় থাকেই, সেটা ভিন্ন বিষয়।

মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের (হাতের কামাই) কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ঘটে। যার দ্বারা আল্লাহ্ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদের আস্বাদন করান, যাতে তারা সংশোধিত হয়।’ ‘তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই হাতের কামাই এর কারণে। অনেক গুনাহ্ তো আল্লাহ্ ক্ষমাই করে দেন।’ ‘আমি তাদের উপর বাঁধভাঙ্গা বন্যা প্রবাহিত করলাম। … সে আযাব আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম কুফরীর কারণে।’ ‘অতঃপর এদের প্রত্যেককে নিজ নিজ পাপের কারণে আমি পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো উপর আমি পাথরকুচির ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে পাকড়াও করেছে বিকট আওয়াজ, কাউকে আবার মাটিতে দাবিয়ে দিয়েছি (ভূমিকম্প), আর কাউকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ্ এমন নন যে, তাদের উপর যুলুম করবেন, বরং তারা নিজেরা নিজেদের উপর যুলুম করত।’ মহাপ্রভূ আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারী অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের সমস্ত বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতাম।’

এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার পর বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বলে নিজেদের দোষ আড়াল করার সুযোগ কি সত্যিই আছে? পর পর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধস, ভূমিকম্প, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ ইত্যাদি দুর্যোগ উপর্যুপরি ঘটে যাওয়ার পরও কি আমাদের হুঁশ ফিরবে না? আমরা সংশোধিত হবো না?

সেল : ০১৭৩১ ৪৭৩৪৩৪ ই-মেইল : huqmahfooz@gmail.com