মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

ভারতের সাহরানপুর মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, বিশ্ববিখ্যাত আলেম, পবিত্র বোখারী শরীফের হাফেজ মাওলানা আবদুল লতিফ (রহ.) ছিলেন পেকুয়ার সিকদার পাড়ার মৌলভী ছাঈদুল হকের সরাসরি ওস্তাদ ও অতি সান্নিধ্য পাওয়া একজন মুরব্বী। ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল মৌলভী সাঈদুল হক রাত্রে স্বপ্নে দেখতে পান-তাঁর ওস্তাদ হজরত মাওলানা হাফেজ আবদুল লতিফ (রহ.) তাঁকে বোখারী শরীফ পড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে তিনি দেখেন-বোখারী শরীফের সব পৃষ্ঠা একেবারে সাদা হয়ে গেছে। তখন বিষয়টি ওস্তাদকে জানালে ওস্তাদ বলেন-যাও, তোমার এবার চুড়ান্ত ছুটি। ঘুম ভাঙ্গার পর মৌলভী ছাঈদুল হক নিজেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বুঝতে পারলেন-তাঁর হায়াত প্রায় শেষ। সে মুহূর্ত হতে মৌলভী ছাঈদুল হক নিজের মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

একদিন পর পয়লা মে পেকুয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম সিকদার পাড়ার দ্বীনের বাতিঘর মৌলভী ছাঈদুল হক সত্যিই মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। বুধবার ১ মে সফল পিতা, আদর্শ শিক্ষক ও হক্কানী আলেম মৌলভী ছাঈদুল হকের ১১ তম মৃত্যুবার্ষিকী। কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সিকদার পাড়া গ্রামে ২০০৮ সালের ১ মে রাত ৯’১৫ টায় তিনি নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী, বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, বর্তমানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে নির্বাসিত জীবনযাপনরত আলহাজ্ব সালাহ উদ্দিন আহমদের গর্বিত জনক মৌলভী সাঈদুল হক। পিতার মৃত্যুর সময় সালাহ উদ্দিন আহমেদ ১/১১ সরকারের রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে কারাগারে ছিলেন। পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজ মাঠে পিতার স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। ক্ষণজম্মা পুরুষ মৌলাভী ছাঈদুল হক ১৯১৩ সালে তৎকালীন বৃহত্তর চকরিয়া থানার পেকুয়া সিকদার পাড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মৌলভী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী আবদুল আলী, মাতার নাম হাকিমন, পিতামহের নাম মৌলভী ইসমত আলী।

কথিত আছে, বিশিষ্ট ইসলাম ধর্ম প্রচারক মৌলভী ছাঈদুল হকের প্রৌপিতামহ মৌলভী মোবারক আলী সৌদীআরব থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এ অন্ঞ্চলে এসেছিলেন। মৌলভী ছাঈদুল হকের সহধর্মিনীর নাম আয়েশা খাতুন। মৌলভী ছাঈদুল হক ও আয়েশা খাতুন দম্পতির ৩ কন্যা ও ২ পুত্ররা হলেন-খাদিজা বেগম, মুসলেমা বেগম, শরিফা বেগম, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও নাছির উদ্দিন। মৌলভী ছাঈদুল হক চট্টগ্রামের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করেন। তিনি চট্টগ্রাম মিনিউসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে ইংলিশ মিডিয়ামে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৯ সালে ভারতের বিখ্যাত শহর সাহারানপুরের প্রসিদ্ধ মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসায় তিনি ভর্তি হন দ্বীনি এলম অর্জনের অভিপ্রায় নিয়ে। সেখানে তিনি দীর্ঘ প্রায় এক যুগ লেখাপড়া শেষ করে ওস্তাতদের পরামর্শে দেউবন্দ থেকে ১৯৫০ সালে দেশে ফিরে আসেন। মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসায় লেখাপড়ার সময় তিনি পৃথিবীর বিখ্যাত আলেম, ওলামা, ইসলামি পন্ডিত ও দ্বীনের বুজর্গদের সান্নিধ্য পেয়ে ধণ্য হন। ১৯৫০ সালে মৌলভী ছাঈদুল হক দেশে ফিরে ঐ বছরই তিনি পেকুয়া জিএমসি ইনষ্টিটিউটে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। শিক্ষার আলো বিতরন করা ছিল তাঁর নেশা। দ্বীনি এলম বিস্তারের জন্য তিনি সবসময় ব্যাকুল হয়ে পড়তেন।পরে পেকুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন নিয়মিত শিক্ষক হিসাবে ১৯৭৫ সালে পেকুয়ার দ্বীনের এই বাতিঘর মৌলভী ছাঈদুল হক অবসর নেন।

একসময় এ বরণ্যে শিক্ষক মৌলভী ছাঈদুল হক টানা চার বছর অসুস্থ ছিলেন। তখন মৌলভী ছাঈদুল হকের গর্ভধারিনী মাতা মহান আল্লাহতায়লার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন-হে আল্লাহ! আমার বুকের ধন মৌলভী ছাঈদুল হককে সুস্থ করে আমার চেয়ে আরো ২০ বছর হায়াত বেশী দিও। সম্ভবত মহান আল্লাহরাব্বুল আলামিন মৌলভী ছাঈদুল হকের গর্ভধারিনী মাতার এই দোয়া কবুল করেছিলেন। যে কারণে মৌলভী ছাঈদুল হকের মাতা ৭৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছিলেন। আর তাঁর পুত্র মৌলভী ছাঈদুল হক তাঁর ছেয়ে ২০ বছর বেশী হায়াত পেয়ে ৯৫ বছর বয়সে ২০০৮ সালে পয়লা মে ইন্তেকাল করেন। সততা, শুদ্ধতা, ন্যায়বোধের মূর্ত প্রতীক দ্বীনের এক মহান সাধক পূরুষ, আলোকিত মানুষ মৌলভী ছাঈদুল হককে তাঁর বাসভবনের উত্তর পার্শ্বে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও হেফজখানা প্রাঙ্গনে শুক্রবার জুমার নামাজের পর নামাজে জানাজা শেষে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। পেকুয়ার দ্বীনের এই বাতিঘরের প্রতি ১১ তম ওফাত বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধান্ঞ্জলী এবং এই আলোকিত মানুষটিকে আল্লাহতায়লা জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন, আমীন!