মো: ফারুক, পেকুয়া: 
তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়তাম পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ইলিশিয়া জমিলা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাড়ি পেকুয়ার উজানটিয়া ইউনিয়নের পেকুয়ার চর এলাকায় হলেও স্কুল জীবনে ইলিশিয়ায় মোকতার আহমদের বাড়িতে থাকতাম। এরই মাঝে
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শুরু হল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। তার আগের দিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলেও ২৯ শে এপ্রিল ভয়াবহ অবস্থা হবে আমরা কল্পনাও করতে পারেনি। যার কারণে রাত ১১টার থেকে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে গেলেও বাড়ি থেকে অন্য কোথায়ও আশ্রয় নেওয়া হয়নি। বাড়িটি দ্বীতল বিশিষ্ট হওয়ায় পানি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পরিবারের সবাই উপরে চলে গেলাম। বাড়ির গৃহকর্তার ছোট ভাই ছিল
মাতারবাড়ি ছিলখালী মৎস্য প্রজেক্টে। রাতে ভয়াবহ অবস্থায় হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার সময় গৃহকর্তার ছোট ভাই এখলাছও মারা যায়। সকালে
পেকুয়াস্থ বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি। যখন ইঞ্জিন চালিত বোটে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয় তখন দেখি শতশত মানুষ মৃত অবস্থায় পানিতে ভাসছে। এছাড়াও পানিতে ভাসছে গৃহপালিত পশুসহ ঘরবাড়ি। চোঁখের কোনায় পানি নিয়ে বাড়িতে পৌঁছলাম। পৌঁছে দেখি আমার পুরো বাড়ি বিধ্বস্ত। মারা গেলে আমার কাছের ১৭জন আত্বীয়। মারা গেলেন আশেপাশের আরো শতাধিক আত্বীয়।  ভয়াবহ অবস্থায় মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে বেঁচে থেকে লাভ কি। তারপরও সবার সহযোগিতায় ১মাস পানির
সাথে যুদ্ধ করে বাড়ি মেরামত করলাম। সেই যেন এক ভয়াবহ অবস্থা ভয়াবহ পরিণতি। ২৯ শে এপ্রিলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন
প্রত্যক্ষদর্শী পেকুয়ার চর এলাকার নুরুল আবছারের ছেলে সাংবাদিক জালাল উদ্দিন। তিনি আরো বলেন, বিগত ২৮বছর পার হলেও অরিক্ষিত থেকে গেছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটি কোটি টাকা বরাদ্ধ দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করার তাগাদা দিলেও কতিপয় ঠিকাদারের দূর্নীতির কারণে মগনামার শরৎঘোনা পয়েন্ট, উজানটিয়ার টেকপাড়া, সোনালী বাজার পয়েন্ট ও সদরের সিরাদিয়া পয়েন্টের কাজ শেষ না করায় উপকূলবাসীর দুঃখ দুঃখই রয়ে গেল। এছাড়াও পর্যাপ্ত তৈরি হয়নি। যার কারণে বারবার স্থানীয়
জনগণ কষ্ট পায়।

২৯ এপ্রিলের স্মৃতিচারণ করে চকরিয়া উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব কাউছার উদ্দীন কছির একটি ফেসবুক পোষ্ট দিয়েছে। পোষ্টটি তুলে ধরা হল।

তখন আমি ৫ম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৯১ সালের ২৯ শে এপ্রিল এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ভয়াবহতম দিন। ঐ দিনে ‘ম্যারি এন’ নামক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। লাশের
পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ
এই আঘাত। স্বজন হারার আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে চারিদিকের পরিবেশ। প্রাকৃতিক দূর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো হয়নি। পরদিন সারা বিশ্বের মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন ধ্বংসলীলা,আর্তনাদে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম
ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম। ২৯শে এপ্রিল রাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের
সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘন্টা)। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে
মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতি.হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। এবং প্রায় এক কোটি মানুষ.আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে।

ঘূর্ণি ঝড়ের সেই রাতে প্রথমে মনে করছিলাম বাতাস বইতেছে বাড়ির চারিপাশে.অনেক আম আর নারিকেল গাছে,আমরা সবাই তখন আম আর নারিকেল কুড়াতে ব্যস্ত,বাড়ির ভিতরে অনেক আম আর নারিকেলের স্তুপ করে ফেললাম, হঠাৎ একটা
টিন উড়ে এসে দরজার সমানে পড়ল তখন ভয়ে সবাই দরজা বন্ধ করে ভিতরে বসে থাকলাম, আধ ঘন্টার মধ্যে বাড়ির বারান্দাায় এক হাটু পানি,সবাই চিন্তায় অস্তির হয়ে গেলাম, মা বাবা সবাই কান্নাকাটি করতেছে সেজ ভাইয়ের জন্য সে.ছিল মাইল্ল্যা ঘোনা প্রজেক্টে, আল্লা আল্লাহ করতে করতে সকাল হল,ভাইকে খোঁজার জন্য বের হলাম আমি আর মেজ ভাই, রওনা হলাম মগখাল হয়ে সওদাগর ঘোনা হয়ে মাইল্ল্যা ঘোনা যাওয়ার জন্য, কিছু দূর গিয়ে আর পা সামনে যায়না, মগখাল আর খাল নাই পরিপূর্ণ হয়ে গেছে মানুষ আর গরু-ছাগলের লাশে, আমি তা দেখে জোরে জোরে কান্না শুরু করে দিলাম, আরো পাঁচ ছয়জন মানুষ সেখানে জড়ো হল, কারো মুখে কোন ভাষা নাই, সবাই মিলে গাছ বাঁশ দিয়ে লাশের স্তুপ ফাঁকা করে নদী পার হলাম, কিছুদুর গিয়ে বাইশ্যা ঘোনা নামক জায়গায় একটা ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ছোট বাচ্চাটির পাশে পড়ে
আছে তার মায়ের লাশ, বাচ্চাটিকে মৃত অবস্থায়ও জড়িয়ে আছে মা, আবাক কান্ড মায়ের ভালোবাসা, আল্লাহ মাকে নিয়ে গেলেও বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে রাখছেন, সঙ্গে যাওয়া লোকদের মধ্যে একজন বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলেন,যা দেখে শিল্পী
সিরাজ ভাই গান করেছিলেন(মারে বেইলত ভাতের অর্থ অইয়ে আরে দেনা ভাত—-) সামনে যতই যাই লাশ আর লাশ, শেষ পর্যন্ত আমাদের গন্তব্য স্থানে গিয়ে খবর ফেলাম সেজ ভাই একটা বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, বেঁচে আছে শুনে আল্লাহর
কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম, পরে তার মুখ থেকে শুনলাম রাতে ঝড় বাতাস শুরু
হলে কোন প্রকারে একটা গাছে উঠে অনেক কষ্টে গাছ কে জড়িয়ে ধরে পানি থেকে বেঁচে গেছেন। সেদিনের নিজের চোখে দেখা স্মৃতি মনে পড়লে এখনও বুকের ভিতর ভূমিকম্প শুরু হয়। সবার সাথে ছোট ছেলে হিসেবে আমিও এক সাথে শত শত মানুষের জানাযা পড়ে কবর দিতে দেখলাম।

সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ত্রাণ তহবিল থেকে আশ্রয়হীন বেঁচে যাওয়া মানুষের মাঝে নৌকা বোট নিয় ত্রাণ বিতরণের সৌভাগ্য সিনিয়র নেতাদের সাথে আমার হয়েছিল বড় ভাই যুবলীগের তৎকালীন সাঃ সম্পাদক আব্বাস উদ্দীনের জন্য। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে আরো যাদের পেয়েছিলাম বর্তমান সাংসদ আলহাজ্ব জাফর আলম এম এ, তৎকালীন উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শ্রদ্ধেয় নুরুল কাদের বিকম, সাঃ সম্পাদক এডঃ আলহাজ্ব আমজাদ হোসেন, যুগ্ন সম্পাদক জিয়া উদ্দীন চৌঃ
জিয়া, জামাল উদ্দীন জয়নাল, আলমগীর চৌঃ, আমিনুর রশিদ দুলাল ভাইসহ অনেককে।
সেদিনের স্মৃতির কথা লিখতে গেলে শেষ করা যাবেনা। ভয়াবহ এ দিনে কক্সবাজার জেলা সহ সারাদেশের নিহত সবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

এছাড়াও মগনামার রেজাউল করিম, সাবেক ইউপি সদস্য মো: লেদু, বর্তমান ইউপি সদস্য আজিজুল হক, বর্তমান উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান আজিজুল হক আজু তাদের স্বজন হারানোর বেদনার কথা জানিয়েছেন।

মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌধুরী ওয়াসিম বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় যখন হয় তখন আমার বয়স বার বছর। ঘূর্ণিঝড়ের সম্পূর্ন স্মৃতি আমার মনে আছে। শতশত মানুষ হারানোর বেদনা এখনো আমাদের
সামনে। সামনের দিনগুলোতেও আমরা ভয়াবহ অবস্থা লক্ষ্য করছি। বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করার জন্য বারবার তাগদা দিলেও কিছুতেই কর্ণপাত করছেনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটি কোটি টাকা বরাদ্ধ দিয়েছে উপকূলবাসীর দুঃখ লাগবে। তা প্রশ্নরে মুখে নিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি। আমি মগনামার সংস্কারবিহীন বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করার দাবী জানাচ্ছি।

বেড়িবাঁধ সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুব-উল করিম বলেন, অসম্পূর্ন বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করার জন্য ঠিকাদারকে তাগদা দেওয়া হয়েছে। আগামী বর্ষার আগে অব্যশই সংস্কার করতে হবে।