আতিকুর রহমান মানিক, বান্দরবান থেকে ফিরেঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদী সাঙ্গু। খরস্রোতা এ নদীতে একসময় মিলত ৩৯ প্রজাতির মাছ। কিন্তু এখন অধিকাংশ মাছই বিলুপ্তির পথে। কারন শুষ্ক মৌসুমে  নদীর পানি শুকিয়ে গেলে অনেকেই সেখানে কীটনাশক ওষুধ ও বিষাক্ত মেলগাছের লতা ব্যবহার করে মাছ শিকার করে। এতে মাছ মরে পানিতে ভেসে উঠলে ছোট বড় সব মাছ ধরে ফেলা হয়। এসব কারণে এ নদীর মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জেলেরা।
বান্দরবান জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, একসময় বান্দরবানের সাঙ্গু নদীতে ডানকিনা, চিতল, তেলাপিয়া, চেলা, চেবলি, চাটকিনি, গুরামুইক্কা, মহাশোল, পাবদা, চিরিং, বাইম, জাত পুটি, ফান্ডা, বোয়াল, বাটা, ফান্ডা বাটা, বামশ, বেলিটুরা, কেচকি, কানকিলা, কাটা চান্দা, কই বান্দি, মৃগেল, বাইলা, গুইল্লা, ছোঁয়া চিংড়ি, গলদা চিখড়ি গুচি বাইম, ঘারুয়া বাচ্চা, কুচিয়া, আইড়, শাল বাইম, কই, দেশি মাগুর, টাকি, ঘনিয়া, চিংড়ি, জায়ান্ট গলদা চিংড়ি, রুই, ভেদা ও কাতলাসহ ৩৯টি প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন এর অধিকাংশ মাছই প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর উৎপত্তিস্থল দুর্গম থানচি উপজেলায়। এ নদীটি থানচি থেকে রুমা উপজেলা হয়ে বান্দরবানে এসেছে। যেহেতু উৎপত্তি স্থল থানচি তাই সেখানেই মাছ বেশি হবার কথা। এবং রুমাতেও মাছ থাকার কথা থাকলেও এ গুরুত্বপূর্ণ দুই উপজেলায় কোনও মৎস্য অফিস না থাকায় মৎস্য সম্পদ উৎপাদন ও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
কর্মকর্তারা আরও জানান, থানচি হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ী এলাকা, মৎস্য অফিস না থাকার কারণে সেখানে তাদের কোনও লোকজন নেই। তাই মাছ রক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দুর্গম থানচি উপজেলাসহ পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মেইল (Rotenon) গাছ সহজলভ্য। এর বিষাক্ত রস পানিতে ছিটিয়ে দিলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মাছ জ্ঞান হারিয়ে পানিতে ভেসে উঠে। উপরোক্ত পদ্ধতিতে মেল গাছের রস ব্যবহার করে প্রায় সময় মাছ শিকার করে স্হানীয় উপজাতি জনগন। এর ফলে নদীর উৎসেই মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও বান্দরবান শহর সংলগ্ন নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে যেখানে মেইল লতার রস নেই সেখানে সরাসরি কীটনাশক ব্যবহার করে চলছে মাছ শিকার। দোকান থেকে ১২৫ টাকায় “সুরক্ষা ১০ ইসি” ও ১৪০ টাকায় “ক্লোরোসেল-৪৮ইসি” সহ বিভিন্ন কীটনাশক বাজার থেকে কিনে এনে নদীতে ব্যবহার করে সব মাছ মেরে ধরে ফেলা হচ্ছে। পর্যটকের চাপ বাড়লে বাড়তি চাহিদা মেটাতে এ পদ্ধতিতে শিকারও বাড়ে। ফলে ধ্বংস হচ্ছে নদীর মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে আরও জানা গেছে, নদীতে গত কয়েক বছর ধরে শুধুমাত্র রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউশ প্রজাতির পোনা প্রতি বছর ছাড়া হলেও অন্য প্রজাতির কোনও পোনা না ছাড়ার কারণে অন্য প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও ২০১৪-২০১৫ সালে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার ৩২৮কেজি মাছের পোনা, ২০১৫-২০১৬ সালে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার ২৯০ কেজি ৫০০ গ্রাম মাছের পোনা (৩১৮.৫৫ হেক্টর এলাকায়), ২০১৬-২০১৭ সালে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ৩৬৬ কেজি মাছের পোনা (২৫.৫৭ হেক্টর এলাকায়) সাঙ্গু নদী ও প্রাতিষ্ঠানিক জলাশয়ে অবমুক্ত করা হয়। এছাড়া ২০১৬-২০১৭ সালে ক্যান্টনমেন্টের জলাশয়ে ৩ লাখ টাকার ৭৬০ কেজি পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।
বান্দরবান শহরের উপকন্ঠে বালাঘাটার জেলেরা জানান, তারা বর্তমানে খুবই অভাবের মধ্যে আছেন। নদীতে আগেরমতো মাছ নেই, আর তাদের কোন জমিও নেই চাষাবাদ করার মতো। আবার নিজেদের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ারও অভিজ্ঞতা নেই। তাই পরিবার নিয়ে তাদের চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে বলে জানান জেলেরা।
বান্দরবান জেলে সমিতির সভাপতি মৎস্যজীবী দিলীপ জলদাশ বলেন, “বর্তমানে জেলে সমিতিতে ১০৮ জন সদস্য রয়েছে। ৩ বছর আগে আমরা ভাতা পেলেও এখন আর পাচ্ছি না। এছাড়া নদীতে আগেরমতো মাছও নেই। আমরা বর্তমানে সারা দিনে ১-২ কে জি মাছ পাই, যা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না”।
তিনি আরও বলেন, নদীতে কালি বাউশ, টাকি, চেলা, বাইলা, টেংরা, আইড়, বোয়াল, চিংড়ি, বাইম, কুচিয়া, চেলা এসব মাছও পাওয়া যায় খুবই সামান্য। কীটনাশক ওষুধ দিয়ে মাছ মেরে ফেলার কারণেও মাছ কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে বান্দরবান সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (সদর) মো. জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘নদীতে প্রতিবছর রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউশ প্রজাতির পোনা অবমুক্ত করা হলেও অন্য কোনও মাছ অবমুক্ত করা হচ্ছে না। যার কারণে এ কয়েক জাতের মাছ ছাড়া অন্য মাছগুলো এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়া ও বর্ষাকালে পানির তীব্র স্রোতে মাছ ভেসে অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণেও অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ রক্ষা করতে হলে নদী খনন করে এর গভীরতা বাড়াতে হবে। তাহলে শুষ্ক সময়ে শুকিয়ে যাবে না ও বর্ষাকালে এর গতি বৃদ্ধি পাবে না। এছাড়া বিলুপ্ত প্রজাতির মাছও নদীতে অবমুক্ত করতে হবে।’
ভাতার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন চাঁদপুর, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও পার্বত্য এলাকা রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের মাছ চাষিরা চাল পেয়ে থাকে। তবে বান্দরবানে একটি মাত্র নদী যা কিনা একদম ছোট, তাছাড়া এখানে জেলের সংখ্যাও কম হওয়ায় জেলেরা চাল বা কোনও সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না।’
বাংলাদেশের পাহাড়ী নদীগুলোর মধ্যে সাঙ্গু অন্যতম। সাঙ্গু নদীর মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানিয়েছেন সচেতন মহল।