শাহেদ মিজান, সিবিএন:

হোটেল শৈবাল গিলে খেতে বিতর্কিত ওরিয়ন গ্রুপের অপচেষ্টা এখনো থামেনি। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে মাঝে বেশ কিছুদিন ‘চুপ’ মেরে থেকে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই ব্যবসায়িক গ্রুপটি। তারা শৈবালকে দখল পেতে আবারো দেনদরবার শুরু করেছে। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টার পর শৈবাল পাওয়ার ‘যুক্তি’ দেখাতে খোদ কক্সবাজারের স্টকহোল্ডারদের সাথে বৈঠক করেছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান। গতকাল শনিবার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৈঠকে তাকে পাত্তাই দেয়নি কেউ। শুধু এক শীর্ষ ব্যক্তি ছাড়া কেউ লিজ দেয়ার পক্ষে মত দেয়নি। উল্টো সবার তোপের মুখে পড়েন ওরিয়ন চেয়ারম্যান।

পর্যটন করপোরেশনের তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে প্রক্রিয়ার পর ২০১৭ সালের দিকে ৪ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার সম্পত্তি প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপে (পিপিপি) ওরিয়ন গ্রুপ নামে একটি কম্পানির কাছে ৫০ বছরের জন্য ৬০ কোটি টাকায় লিজ দেয়ার চুক্তি করে। তবে তা করা অতি গোপনে। ওই চুক্তি বলে ২০১৮ সালের ৩০ জুন ওরিয়ন গ্রুপ আকস্মিক এসে সাইনবোর্ডও টাঙিয়েছিল। তারপর পানির দামে কক্সবাজারের পর্যটনের এই বিরাট সম্পদকে লিজ দেয়ার বিষয়টি জানতে পারে কক্সবাজারের মানুষ। এরপর শৈবাল রক্ষা করতে আন্দোলনে নেমেছেন সচেতন কক্সবাজারবাসী। সেই সময় হরতাল, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানাভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল কক্সবাজারের সচেতন মানুষ। তৎকালীন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কক্সবাজারবাসী কোনোভাবে শৈবাল লিজে মত দেয়নি। উল্টো লিজ দেয়া হলে তা যেকোনোভাবে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কক্সবাজারবাসীর প্রতিরোধের পিছু হটে ছিলো ওরিয়ন গ্রুপ।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ওরিয়ন গ্রুপকে হোটেল শৈবাল লিজ দেয়া প্রসঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয় এবং এই বিষয়ে আবারো স্থানীয় স্টকহোল্ডারদের সাথে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সে মোতাবেক গতকাল শনিবার (২৭ এপ্রিল) জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোঃ আশরাফুল আবছারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত বৈঠকে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, মহেশখালী কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ কক্সবাজারের রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সংশ্লিষ্ট আরো অনেক উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম বিভিন্নভাবে শৈবাল লিজ পাওয়ার ব্যাপারে যুক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি নানাভাবে তার পক্ষে মত আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু সরকার ও পর্যটনের স্বার্থে উপস্থিত কেউই তার মতের পক্ষে ইতিবাচক সাড়া দেননি। তবে এক শীর্ষ জনপ্রতিনিধি ওরিয়ন গ্রুপের পক্ষে মত প্রকাশ করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। তার বক্তব্যের জন্য অন্যরা কৌশলগতভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে ঝুলন্ত লিজ চূড়ান্তভাবে বাতিলে দাবি জানান। শেষে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘হোটেল শৈবাল কক্সবাজারের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। এই হোটেলটি ও তার পরিবেশ কক্সবাজারকে এক অনন্য সৌন্দর্য্য দান করেছে। এমন একটি হোটেল পানির দামে লিজ দেয়া যায় না। আমরা শুরু থেকেই এর বিপক্ষে ছিলাম, এখনো লিজের বিপক্ষে আছি। কোনোভাবেই লিজ দেয়া হবে না।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘হোটেল শৈবাল শুধু কক্সবাজারবাসী নয়; সরকার ও পর্যটনের বিরাট সম্পদ। এট বেসরকারি খাতে চলে গেলে সরকারই বেশিগ্রস্ত হবে। একই সাথে এটি কোম্পানির হাতে চলে গেলে তারা পরিবেশ নষ্ট করে স্থাপনা তৈরি করবে। তাই আমরা কোনোভাবেই এটি বেসরকারি কোম্পানিকে লিজ দেয়ার পক্ষে না। এটি লিজ দেয়া যেতে পারে না।’

তথ্য মতে, ১৯৬৫ সালে সাগরিকা রেস্তোরাঁ চালুর মধ্য দিয়ে কক্সবাজার পর্যটনে হোটেল শৈবালের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে সাগরিকা নামের রেস্তোরাঁটি ভোজনরসিকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে টিকে রয়েছে। পরে ১৯৮৫ সালে রেস্তোরাঁ সংলগ্ন তিন তারকা বিশিষ্ট হোটেল শৈবাল (আবাসিক) প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়। চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে পর্যটক ও স্থানীয়দের কাছে হোটেল শৈবাল বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। আজও হোটেল শৈবাল পর্যটন শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। হোটেল শৈবালের মোট জমির পরিমাণ ১৩৫ একর। তার মধ্যে ১৩০ একর জমি পিপিপি প্রকল্পের আওতায় হস্তান্তর করার কথা রয়েছে।

একই সঙ্গে ১৩০ একর জমি ছাড়াও হোটেল শৈবালের অত্যাধুনিক তিন তলা ভবন, সাগরিকা রেস্তোরাঁ ভবন, সুইমিংপুল ভবন, লাইভ ফিস রেস্তোরাঁর দোতলা ভবন, শৈবালের গলফবার ভবনসহ মোট ১৪০ কোটি টাকার ভবনও হস্তান্তর করা হবে। পর্যটন এরিয়ার প্রাইম লোকেশনে হোটেল শৈবালের প্রতি শতক জমির মূল্য ন্যূনতম ৩৫ লাখ টাকা ধরা হলে ১৩০ একর জমির মূল্য প্রায় ৪ হাজার ৫৫০ কোটি। এছাড়া হোটেল শৈবালের ভবনসহ আশপাশের অন্যান্য ভবনের মূল্য ১৪০ কোটি টাকা।