সিবিএন ডেস্ক: জিন-ভূত তাড়ানোর নামে তরুণীদের সঙ্গে পর্নো ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে গ্রেফতার ‘ভণ্ডপীর’ আহসান হাবিব পিয়ারের বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক সজীবুজ্জামান পর্নোগ্রাফি ও আইসিটি আইনে চার্জশিট দু’টি দাখিল করেন।

খিলগাঁও থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক আশরাফ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামি আহসান হাবিব পিয়ার (২৬) ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জিন তাড়ানো বা কবিরাজি তাবিজ দেওয়ার নাম করে মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলতো। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা তথা ইলেকট্রিক ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়ে/মহিলাদের অজ্ঞাতে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন করার লক্ষ্যে স্থিরচিত্র, ভিডিওচিত্র ধারণ করতো। তা দিয়ে ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদাহানি ঘটানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করত।

প্রাথমিকভাবে অভিযোগগুলো সত্য বলে প্রতীয়মান হওয়ায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ৮ (১), ৮(২), ৮(৩) ধারায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ (২) ধারা এবং পেনাল কোডের ৩৮৫/৪০৬/৪২০/৫০৬ ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হলো।

জিন তাড়াতে আসা মেয়েদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক

ভণ্ডপীর আহসান হাবিব পিয়ার ২০১৭ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম এ কে এম মাঈন উদ্দিন সিদ্দিকীর আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। জবানবন্দিতে সে জানায়- ‘২০১০ সাল থেকে আমি ঢাকায় থাকি। তখন আমি জিন তাড়ানোর তাবিজ বিক্রি করতাম। পরে টাকা আয়ের নতুন বুদ্ধি বের করি। এএইচপি (ahp) নামের ভুয়া টিভি চ্যানেল তৈরি করে বিভিন্ন রিপোর্ট বানাতাম আর তাতে দেখাতাম গরিব অসহায় ও অসুস্থ ব্যক্তির মাঝে টাকা বিতরণ করছি। বিনিময়ে সারাদেশ ও বিদেশ হতে আমার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট এবং অনেকগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অনেক টাকা রোজগার করতাম। জিন তাড়ানোর নামে তাবিজ নিতে যেসব মেয়েরা কাছে আসত আমি তাদের সাথে সেক্স করতাম এবং গোপনে তা ভিডিও করে ইউটিউবে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে মেয়েদের থেকে টাকা আদায় করতাম। তাদের মধ্যে একজন হতে চার লাখ এবং অপর একজনের কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা আদায় করি। এছাড়াও অন্য মেয়েদের থেকেও টাকা আদায় করি।

ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি

মামলার ভুক্তভোগী দুই নারী ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন, আসামি পিয়ারের সঙ্গে ফেসবুকে তাদের পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে আসামির নিয়মিত কথোপকথন হতো বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যেমে। কথা বলার এক পর্যায়ে আসামি তাদের সঙ্গে অডিও-ভিডিও ফোনসেক্স করে। ভিডিও ফোন সেক্সের অংশ আসামি অসৎ উদ্দেশ্যে গোপনে রেকর্ড করে রাখে। পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করে আসামি তাদের নিকট হতে কয়েক ধাপে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং নগদ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে নেয়।

আসামি আহসান হাবিব পিয়ার ভুক্তভোগী নারীদের পুনরায় টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে তার আচার-আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তারা বিষয়টি সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগকে অবহিত করেন।

যা বললেন পিয়ারের গাড়ি চালক

১৬১ ধারার জবানবন্দিতে আহসান হাবিব পিয়ারের গাড়ি চালক তুহিন হাওলাদার বলেন, তিনি আহসান হাবিব পেয়ারের গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন। মাঝে মাঝে পিয়ার বিভিন্ন জায়গা হতে মেয়েদের গাড়িতে তুলত এবং আনন্দ ফুর্তি করত। তিনি বারবার নিষেধ করলেও পিয়ার তা শুনত না বরং বলত আপনি আমার ড্রাইভার, ড্রাইভারের মতোই থাকবেন।

মেয়েদের বাসায় নিয়ে আসতে বলতো পিয়ার

আহসান হাবিব পিয়ারের ক্যামেরাম্যান ছিলেন জাবেদ। নিজের জবানবন্দিতে তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন প্রোগামে আহসান হাবিব পিয়ারের ভিডিওচিত্র ধারণ করতাম। মাঝে মাঝে সে আমাকে বিভিন্ন জায়গা হতে মেয়েদের তার বর্তমান ঠিকানায় বাসায় নিয়ে আসতে বলত। তার কথা না শুনলে সে আমার ক্ষতি করবে বলে হুমকি প্রদান করত।

যে অভিযোগে পিয়ারের বিরুদ্ধে চার্জশিট

আসামি আহসান হাবিব পিয়ার (২৬) ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জিন তাড়ানো বা কবিরাজি তাবিজ দেওয়ার নাম করে মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলেতো। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা তথা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়ে/মহিলাদের অজ্ঞাতে পর্নোগ্রাফি তৈরির লক্ষ্যে স্থিরচিত্র, ভিডিওচিত্র ধারণ করতো। সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদাহানি ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায় করতো। ইলেকট্রনিক ডিভাইসে তা সরবরাহ করায় তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ৮ (১), ৮(২) ও ৮(৩) ধারায় অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন গরিব ও অসহায় লোকদের সহায়তার কথা বলে মিথ্যা, আপত্তিকর ও মনগড়া তথ্য সম্বলিত স্থিরচিত্র এবং ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক বা ইউটিউবে প্রকাশ করায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ (২) ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবে এএইচপি টিভি নামের ভুয়া টিভি চ্যানেল খুলে ওই চ্যানেলের মাধ্যমে বিভিন্ন গরিব ও অসহায় লোকদের সাহায্যের কথা সম্বলিত বিভিন্ন স্থিরচিত্র এবং ভিডিওচিত্র আপলোড করে অন্যের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতারণার মাধ্যেমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অসৎ উপায়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় পেনাল কোডের ৩৮৫/৪০৬/৪২০/৫০৬ ধারায় বর্ণিত অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে শাস্তির মুখোমুখি হবে পিয়ার

আইসিটি আইনের মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৭ থেকে ১৪ বছরের সাজার মুখোমুখি হবে এই ভণ্ডপীর। অন্যদিকে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কোনো নারী, পুরুষ বা শিশুকে প্রলোভন দিয়ে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্থির, ভিডিও বা চলচ্চিত্র ধারণ করলে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে।

আরো বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে কারও সম্মানহানি করে বা কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে বা করার চেষ্টা চালায় তবে বিচারক ২ থেকে ৫ বছর মেয়াদি কারাদণ্ড আরোপ করতে পারবেন এবং সেইসঙ্গে ১ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড আরোপ করতে পারবেন।

শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও বিতরণকারীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং অধিকন্তু ৫ লাখ টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, বেশ কয়েকজন নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁও থেকে ভণ্ডপীর আহসান হাবিব পিয়ারকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। ওইদিনই তার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সহকারী উপ-পরিদর্শক লুৎফর রহমান।

তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ আগস্ট ঢাকার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত পিয়ারের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম এ কে এম মাঈন উদ্দিন সিদ্দিকীর আদালতে পিয়ার ঘটনা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। এরপর থেকে কারাগারে আটক আছে ভণ্ডপীর পিয়ার।