সাইফুল ইসলাম বাবুল :

আমরা সবাই জীবন নামক রেলগাড়িটাতে বসে আছি; তার গন্তব্যস্থল হচ্ছে পরকাল। আমাদের স্বাধীনতা শুধু এতটুকুই; যতটুকু স্বাধীনতা থাকে একটা উড়ন্ত ঘুড়ির’ মুক্ত আকাশে স্বাধীন মনে উড়ন্ত ঘুড়ি নিশ্চিন্তে উড়তে থাকে। নানা রঙের এই ঘুড়ি গুলো তাদের ডানা মেলে শুধু উড়েই চলে। সে ভাবে তাকে ছোঁয়ার মত বুঝি কেউ নেই। অথচ নাটাই হাতে একজন বসে আছেন। আর সুতো ছেড়ে দিয়ে বলছেন; যা যতদূর পারিস উড়ে যা; তবে যখন সুতায় টান পড়বে তখন নিচে চলে আসতে হবে। ‘মানব জীবন ঠিক তা-ই। আমরা যত শক্ত হাতেই দুনিয়াকে আকড়ে ধরিনা কেন;’মহান আল্লাহ পাক চাইলে নিমিষেই আমাদের প্রত্যেক কে তারই কাছে ফিরে যেতে হবে। এ কথাটি যদি আমাদের সকলের জানা থাকে। এর ভাব ধারা যদি হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করতে পারি। তাহলেই আমাদের জীবনের প্রতিটা কদম হিসেব করে দেয়া সমীচীন হবে। ক্ষুদ্র দুনিয়ার বিন্দু পরিমান সময়ের অস্থায়ী এই জীবন আমাদের জীবন নয়। এক বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ে যে আখেরাত। সেই আখেরাতের স্থায়ী অনন্তকালের জীবনই হচ্ছে; ”আমাদের জীবন”।

আজকে হাসপাতালে আমার সমবয়সী একটা ছেলেকে মারা যেতে দেখলাম। আমি চিন্তা করলাম আজকে ওর জায়গায় যদি আমার মৃত্যু হতো তাহলে আমার কি হতো? আমি খুব ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। এখনও আমার খুব ভয় হচ্ছে মৃত্যুর কষ্টটা না জানি কি ভয়ংকর হতে পারে!!

এ ভাবেই হয়তো চলে গেছে জীবনের অনেক সময় অর্ধেকের ও বেশী অথবা পুরোটাই। তবুও জানিনা কখন যে মৃত্যুদূত আলিঙ্গন করার অভিলাসে দাঁড়াবে দরজায়। অথচ তাকে অভিবাদন জানাবার মত হিম্মত নেই বুকে এতোটুকুও। গড্ডলিকায় গা ভাশাতে ভাশাতে পেলে এসেছি সব দিন। সত্যকে ঢেকে দিয়ে আড়ালে আবডালে চলে এসেছি আজ গৌ্ধূলীর শেষ লগ্নে। আজ মৃত্যুর মুখোমুখী হবার ভয় কিন্তু লুকাবো কোথায় পালাবার সকল পথ যে রুদ্ধ। আজ সত্যের মুখোমুখী হয়ে দাড়াতে হবে কাঠগড়ায়। শাহেন শাহর নিকট জবাব দিহিতায়। কিন্তু এই অসুস্থ আত্না নিয়ে কিভাবে দাড়াবো তার সামনে। কি জবাব দিবো সে দিন যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছো দু্নিয়ায়। বিন্ধু মাত্র ও তার করিনি পালন, দুনিয়ার মোহে পড়ে সে দায়িত্ব থেকে নিজেকে আড়ালে রেখেছিলাম। যে সম্পদ ও জীবন দিয়েছো তোমার দ্বীনের জন্য তা ব্যায় করিনি এতটুকুও। জীবনের মূল্যবান সময়টার সবটুকুই ধর্মহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে অতিবাহিত করেছি। এই যদি হয় আমাদের জীবনের অবস্থা। তবে আমাদের আবারো জেনে রাখা মঙ্গল ময় হোক ‘যে ক্ষুদ্র এই জীবনের সময়ের পালা একদিন শেষ হবেই অর্থাৎ বয়সের সীমারেখা যখন সন্নিকটে চলে আসবে তখন এই মায়াবী পৃথিবীর এক সেকেন্ডও ভরশা না করে চলে যেতে হবে পরকালে। এটাই আমাদের জীবন; আর এটাই হল শেষ জীবন; আমরা সবাই পরকালের গন্তব্যবাসী।

পূর্ব দিগন্তে নব সজীবতায় ভোরের টুকটুকে লাল সুর্য উদিত হচ্ছে। সে তার স্রষ্টার একান্ত অনুগত হয়ে অনবরত তারই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। আর কালের স্বাক্ষী হয়ে সেই সত্যতা প্রমান করে যাচ্ছে। গতকাল ও সে এমন অনেক কেই আলো দিয়েছিলো। যার কেউই আজ পৃথিবীতে নেই, সে জানেও না তারা কোথায় গেছে। কিন্তু আমরা জানি,তারা কোথায় গেছে। আমাদেরকেও সেই গন্তব্য যেতে হবে। আমরা সবাই সেই গন্তব্যরই এক একজন পথচারি মাত্র। কাল ভোরে আবার সুর্য উদিত হবে নব সজীবতার আলো দিয়ে আবারো জাগাবে এই পৃথিবীর মানুষ গুলোকে। কিন্তু সে খানে হয়তো আমি থাকবোনা। কারন এই পৃথিবীতে আমরা কেউই চিরঞ্জীব নই। কেউ এটা আশা করতে পারেনা যে ‘আমি সারাটা জীবন এটা করবো ওটা নিয়ে দিন কাটাবো। এমন কেউ কি আছেন যে; নির্দিষ্ট একটা জীবনের প্যাকেজ নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন? আমার মনে হয়! এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে একজন ও নেই। কারন,জীবন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন শীল। এই পরিবর্তন শীল জীবন নিয়ে পৃথিবীর মানুষেরা আপন ভাগ্যের বিকাশ-প্রকাশে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কোনোরকমে তার বয়ষের সীমারেখা অতিক্রম করে যাচ্ছে।

কূয়াশার চাদর ঘেরা মিটি মিটি অন্ধকার ভেদ করে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি স্পন্দিত হল কানে। ভয় মিশ্রিত এক অনুভূতির হাওয়া আমাকে শিহরিত করল। নিমেশেই দু’চোঁখ খুলে গেল, যেন মৃত্যুর পর আবার আমি এক নব জীবনে জাগ্রত হলাম। নতুন এক সজীবতায় নিজেকে খুজে পেলাম। আর ভাবনার দুয়ারে কে যেনো নক করে বলে গেল। “হে মানুষ, এই ঘুম যদি না ভাঙ্গতো তোমার? পুনরায় দু’চোঁখ মেলার শক্তি যদি হাঁরিয়ে পেলতে? যদি এই সুন্দর পৃথিবীকে আবারো দেখার সুযোগ না হতো? তবে কিই-বা করার ছিল তোমার? মহান সৃষ্টিকর্তা অনুগ্রহ করেছেন বলেই তুমি আবার দু’চোঁখ মেলবার সুযোগ পেয়েছো। তাই মুয়াজ্জিন যে আহবানে ডাকছে তোমায়,তার ডাকে সাড়া দিয়ে সেই মহা মনিবের নিকট শুকরিয়া আদায় করো। আগামী ভোর তোমার জন্য হতে পারে পরকাল। সেখানে তো ঘুমিয়ে থাকবে এক অনন্ত কালের জন্য। তাই নিশ্বাস পুরোবার আগেই আরো কিছু সঞ্চয় করে নাও। যা পরকালের সেই কঠিন সময়ে তোমার একান্ত কাজে লাগবে।

যে সবসময় মৃত্যুকে স্মরণ করে, তার অন্তর কোমল হয়। তার আমল ও অবস্থা পরিশুদ্ধ হয়। সে আল্লাহর অবাধ্যতা করার সাহস পায় না। শরীয়াহ নির্ধারিত ফরয তথা অবশ্যকরণীয় কাজগুলোর ক্ষেত্রে অবহেলা করে না। পার্থিব জীবনের চাকচিক্য তাকে মোহাচ্ছন্ন করতে পারে না। সে তার রব ও নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতের ব্যাপারে আগ্রহী হয়।

আজকে আমরা ঘরে একা একা থাকতে ভয় পাই। কিন্তু মৃত্যুর পরে কবরে আমাদের একাই থাকতে হবে। আজকে আমরা বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন মিলে থাকি। মরণের পর কেউই আমাদের সাথে থাকবে না। কবরে একা একা কিভাবে থাকবো এটা চিন্তা করলে গা শিউরে উঠে। মানুষ সৃষ্টির সূচনাতে জান্নাতে আদম (আ) এর সাথে শয়তানের প্ররোচনার যে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে এ কারণেই যে মানুষ যাতে মনে করে তাদের প্রথম আবাস ছিল জান্নাত। দুনিয়া তাদের আসল ঠিকানা নয়। পৃথিবীতে আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করার জন্যই পাঠিয়েছেন। যারা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তারাই স্থায়ী আবাস জান্নাতে পুনরায় যেতে পারবে।

আমরা দেখি যে দুনিয়াতেও পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ছাত্রের মেধার মূল্যায়ন করা হয়, পড়ালেখার মূল্যায়ন করা হয়। আমরা আমাদের যেকোন একাডেমিক পরীক্ষার আগে খুব বেশি পড়াশুনা করে ভালোভাবে পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু মৃত্যুর পরও আমাদের যে জীবনের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে আমরা কি সে পরীক্ষার জন্য কখনও কোন প্রস্তুতি নিয়েছি? আমরা কি কখনও আমাদের মৃত্যুর কথা চিন্তা করি?

দুনিয়ার কোন পরীক্ষায় কোন ছাত্র ভালো করলে দেখা যায় যে বাবা-মা, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন খুব খুশি হয়, চারদিকে তার অনেক প্রশংসা করা হয়। কিন্তু যে খারাপ করে সে কারো সাথে কথা বলতে-দেখা করতেও চায় না। সে নিজেকে সবচেয়ে বেশি অপমানিত মনে করে। তেমনিভাবে দুনিয়ার জীবনও হলো আখিরাতের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। যারা এই সময়গুলো আল্লাহর বিধি নিষেধ মেনে চলবে তারা আখিরাতের পরীক্ষায় সফলতা লাভ করবে। আখিরাতের প্রতিটি ধাপে হাসি-খুশি থাকবে। আর যারা দুনিয়ার জীবনে নাফরমানি করবে তারা অকৃতকার্য ও অপমানিত হবে। তাদের চেহারা মলিন হয়ে যাবে।
দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সেতুবন্ধন হচ্ছে মৃত্যু। আমরা যদি প্রতিদিন আমাদের মৃত্যুর কথা চিন্তা করি তাহলে আমাদের পক্ষে কোন খারাপ কাজ সংঘটিত করা সম্ভব না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাফরমানি করাও সম্ভব না। আমাদের বোধের উদয় হোক। সর্বোপরী পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়; মরন একদিন মুছে দিবে সকল, এ প্রত্যাশায়…।