>> সিজারে অর্থনৈতিক চাপে দরিদ্র জনগোষ্ঠী 
>> ৩১ শতাংশ প্রসব হচ্ছে সিজারে 
>> আমি হাসপাতালে গেলেই তো সিজার করে দেবে, গ্রামে ভীতি

সন্তান প্রসবসম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবারগুলো সিজারে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে থাকে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব হেলথ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে আইসিডিডিআরবির গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।

গবেষণার তথ্য মতে, স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার সুযোগ থাকা জায়গায় সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হলে প্রতিটি জন্মে গড়ে ২১ হাজার ১২১ টাকা (২৫০ ডলার) ব্যয় হয়। অপরদিকে স্বাভাবিকভাবে জন্ম হলে মাত্র পাঁচ হাজার ৬৯ টাকা (৬০ ডলার) ব্যয় হয়।

বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসব সিজারিয়ান বা সি-সেকশনে করানোর সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সীমা ছাড়িয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

দিন দিন সিজারিয়ান অপারেশন বাড়ার জন্য বেসরকারি ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা, সরকারি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হওয়া এবং ডাক্তারদের নৈতিকতার ঘাটতিকে দায়ী করছেন গবেষকরা।

চলতি বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা : সবার জন্য সর্বত্র’। এতে আর্থিক কষ্ট ছাড়াই গুণগত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং বলা হয়, স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের ফলে প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের দিকে চলে যাচ্ছে।

আসিডিডিআরবি’র গবেষণায়ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সিজারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে প্রায় ৩১ শতাংশ প্রসব হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে।

আইসিডিডিআরবি’র সহযোগী বিজ্ঞানী ও দ্য ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব হেল্থ প্লানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে প্রকাশিত গবেষণাটির মূল লেখক ডা. আব্দুর রাজ্জাক সরকার বলেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বিত্তবানরা সন্তান জন্মের সময় প্রতি প্রসবে প্রায় ২৮০ মার্কিন ডলার ব্যয় করেন।

তবে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোও সিজারের ক্ষেত্রে অন্তত ২০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করেন,’- যোগ করেন তিনি।

সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর এ ব্যয় বাংলাদেশের জন্য খুবই ভয়ানক একটি ব্যাপার। কারণ, যেখানে সর্বস্তরের জনসাধারণকেই এখনও স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা যায়নি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) তথ্যনুসারে, চার হাজার ৫০০টি সন্তান প্রসবের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে ডা. সরকার বলেন, আমরাও আরও লক্ষ্য করেছি, যেসব নারীর বয়স ৩৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্য তারা বেশি ব্যয় করছেন এবং আশ্চর্যজনক বিষয় হলো যারা সন্তান জন্মের আগে থেকেই স্বাস্থ্যসেবা নিয়মিত নিয়েছেন এমনকি অনেক উচ্চ শিক্ষিত নারীরাও সিজারে বেশি ব্যয় করেছেন। শহরাঞ্চলে এ চিত্রটি সবচেয়ে বেশি।

তিনি আরও বলেন, সন্তান প্রসবের এ অতিরিক্ত ব্যয়ের বেশিরভাগই আসে পারিবারিক উৎস (আয় ও সঞ্চয়) থেকে। এতে করে ওই পরিবারের জীবনযাত্রা ও দৈনন্দিন গৃহস্থালিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিজারিয়ান প্রসবের সংখ্যা শতকরা ৩১ ভাগ, যা বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত হারের দ্বিগুণেরও বেশি। তাদের নির্ধারিত হার অনুযায়ী, এই সংখ্যা হতে পারে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ।

নানা কারণে সিজারিয়ানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল।

প্রাইভেট ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা

কারণগুলো মধ্যে অন্যতম হলো প্রাইভেট ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা। এ কারণে বাংলাদেশে সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়ার কথা জানান চিকিৎসক কাজল। তিনি বলেন, সিজারিয়ান বাড়ার প্রথম কারণটা কিন্তু অর্থনৈতিক। ৯৫ ভাগ ক্লিনিকের আয়ের উৎস সিজারিয়ান অপারেশন।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-২০১৪ (বিডিএইচএস)-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। এ ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি।

সিজারিয়ানের সংখ্যা কমানোর জন্য চিকিৎসকদের বিবেক জাগ্রত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ডা. কাজল বলেন, চিকিৎসকদের বিবেক যদি না জাগে, এটা বন্ধ করা যাবে না। আর ক্লিনিকগুলোতে সিজারিয়ান অপারেশনগুলো মনিটরিংও করতে হবে। কেন করল, অন্য উপায় নিয়েছে কি-না, সেটা দেখতে হবে। মাসে সে কতগুলো সিজারিয়ান করল কোন ক্লিনিক প্রভৃতি।

একইসঙ্গে সরকারি হাসপাতালে বিশ্বাসযোগ্যতায় আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রেটটা অনেক কম। সরকার চেষ্টা করছে, নার্স রেখে, মিডওয়াইফ রেখে, তাদেরকে প্রণোদনা দিয়ে স্বাভাবিক পথে ডেলিভারি করতে উদ্বুদ্ধ করতে।

প্রথমবারের ফাঁদে মায়েরা

ক্লিনিকগুলোর ফাঁদে পড়ে কিংবা চিকিৎসকদের অসাবধানতায় প্রথমবার সিজারিয়ান করার ফলে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের সময় বাধ্য হয়েই আগের পথে হাঁটতে হচ্ছে বলে মনে করেন ডা. কাজল।

‘প্রথমবার যখন কারো সিজারিয়ান অপারেশন করে ফেলে, তখন বাধ্য হয়েই দ্বিতীয়বার সন্তান প্রসবের সময় সিজারিয়ান করতে বাধ্য হচ্ছে ডাক্তাররা। কারণ, যদি প্রসব বেদনার সময় হাসপাতালে সব ধরনের সুবিধা না থাকে, তাহলে দ্বিতীয়বার সিজারিয়ান ছাড়া প্রসবের ঝুঁকি নেয়া যায় না,’- বলেন তিনি।

‘প্রথমবার যেহেতু লাখ লাখ মায়ের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান হয়ে গেছে, তখন দ্বিতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রেও তাদের সিজার হবে। সে কারণে রেটটা দিন দিন বাড়তে থাকবে। এমন একটি চক্রের মধ্যে পড়েছি আমরা।’

প্রথমবার সিজারিয়ানের পর দ্বিতীয়বার স্বাভাবিক প্রসবে ঝুঁকি ব্যাখ্যা করে ডা. কাজল বলেন, কোনো কারণে প্রসব বিলম্বিত হলে মায়ের জরায়ু ফেটে যেতে পারে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন না করলে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। এই বিপদের কারণে বিদেশে সিজারিয়ান রোগীকে দ্বিতীয়বার স্বাভাবিকভাবে প্রসবের ঝুঁকি নিলেও সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে নেয়া সম্ভব হয় না।

শিক্ষিতদের মধ্যে সিজারিয়ানের হার বেশি

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মায়েরা অন্যদের তুলনায় বেশি খরচ করছেন। অন্যদিকে, শহুরে নারীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত এবং জন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন, তারাও এই বেশি খরচের পথই ধরছেন।

মায়েদের মধ্যে প্রসব নিয়ে ভীতি কাজ করাকে সিজারিয়ান বাড়ার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন চিকিৎসক কাজল। ‘আমাদের মায়েরা রিস্ক নিতে চান না। এ কারণে হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মায়েদের জন্য ২৪ ঘণ্টা একই মানের সেবা থাকতে হবে’,-বলেন তিনি৷

মানুষের মধ্যে সিজারিয়ান নিয়ে ভীতি আছে বলে মনে করছেন অনেকে। ‘গ্রামে ভীতি তৈরি হয়েছে। অনেকে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান না। তারা বলেন, আমি গেলেই তো সিজার করে দেবে,’ বলেন চিকিৎসক কাজল।