ডেস্ক নিউজ:
দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি কোন প্রক্রিয়ায় সে বিষয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। তার মুক্তির বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। আন্দোলনের মুখে, আদালত থেকে জামিনে, না কি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া- প্যারোলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে? কোন পথে গেলে খালেদার মুক্তি মিলবে- সে সিদ্ধান্ত কি নিতে পেরেছে বিএনপি?

বিএনপির একাংশ বলছে, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া উচিত এবং তারা মনে করে বিষয়টি সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আবার সরকারের তরফ থেকে মন্ত্রীদের মধ্যেও নানা ধরনের বক্তব্য রয়েছে।

বেগম জিয়া কারাগার থেকে যেকোনো মূল্যে মুক্ত হোক- এমনটাই আশা করছেন দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তবে মুক্তির পথ কোনটি? প্যারোল, জামিন না কি আন্দোলন?

কীভাবে খালেদার মুক্তির ব্যবস্থা হবে? এ বিষয়ে আলোচনা চলছে চায়ের স্টল থেকে, অফিস-আদালত, পত্র-পত্রিকা, টকশোসহ সবার মধ্যে। এছাড়াও বিএনপি নেত্রীর মুক্তি নিয়ে আরও একটি গুঞ্জন রয়েছে সর্বত্র। তিনি (খালেদা) যদি প্যারোলে মুক্তি নিতে চান, তবে তার পক্ষে কে প্যারোল চাইবেন? তার ছেলে, ছেলের বউ এবং নাতনিরা কেউই এই মুহূর্তে দেশে নেই। তারা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তা হলে তার পক্ষে প্যারোলের আবেদকারী হবেন কে?

জানা গেছে, কারো প্যারোল চাইতে আবেদন করতে হয় কারাবন্দির নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোল নিতে চাইলে তার পক্ষে আবেদনকারী কে হবেন- এমন প্রশ্ন উঠেছে।

যদিও বিএনপির একাধিক নেতা ও দলীয় আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিতে চাইবেন না, তিনি কখনও প্যারোলের জন্য রাজি হবেন না। কিন্তু কোনো কারণে যদি তিনি প্যারোল নিতে রাজি হন তবে তার পক্ষে প্যারোলের আবেদন কে করবেন?

বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান এবং তারেক ও কোকোর মেয়েরা কেউই দেশে নেই। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ভাই-বোনদের কেউ আইনজীবীর মাধ্যমে প্যারোল চাইতে পারেন বলে সূত্রে জানা গেছে।

এখন বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলন, আদালতে জামিন নিয়ে না কি প্যারোলে সেটাই দেখার বিষয়। আদালতের মাধ্যমে বলতে মামলায় সাজা থেকে বেকসুর খালাস বা জামিন পেলে মুক্তি মিলতে পারে। অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য প্যারোলও হতে পারে মুক্তির অন্য পথ। কারাগার থেকে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত বা আটক ব্যক্তি মুক্তি দুই পথেই দেশের আইনি প্রক্রিয়া বিদ্যমান রয়েছে।

কিন্তু খালেদার মুক্তি জামিনের মাধ্যমে হবে, না কি প্যারোল হবে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে আড়ালে সরকার ও বিএনপির মধ্যে দেনদরবার হচ্ছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

এক সূত্রের দাবি, কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তি অবশ্যই কিছুটা শর্ত সাপেক্ষে হবে। তবে কী সেই শর্ত, সেটি এখনও ঠিক-ঠাক হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপির নির্বাচিত ছয় সদস্যের সংসদে যোগদান একটি শর্ত হতে পারে। আবার কারও মতে, ওই ইস্যুটি সরকারের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণই পাচ্ছে না। কারণ সরকারের এই পর্যায়ে এসে এসবের আর প্রয়োজন নাই। বরং তাদের আশঙ্কা, সমঝোতার আগে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি না করার শর্ত জুড়ে দেয়া হতে পারে। তবে, ওইসব শর্ত মেনে খালেদা জিয়া মুক্তি নিতে রাজি হবেন বলে বিএনপির অনেক নেতাই বিশ্বাস করেছেন না।

দলীয় নেতারা মনে করেন, আইনি প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসনের মুক্তি আরও বিলম্বিত হতে পারে। তাছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আইনি প্রক্রিয়ায় কিংবা রাজপথের কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে চেয়ারপারসনকে মুক্ত করা কঠিন। এতে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। তবে সেটা কোন পথে?

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে সরকার প্রথম থেকেই ইতিবাচক। অসুস্থ হওয়ার আগে গত বছরের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিএনপি চাইলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন, সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এখন প্যারোল বা জামিন কিছুই হবে না- এটি স্পষ্ট। জামিন হলেও তা সমঝোতার ভিত্তিতে হয়েছে বলেই মানুষ মনে করবে- আশঙ্কা দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আপাতত খালেদার মুক্তি ও চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপি।

গুঞ্জন রয়েছে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে পারেন। একই ধরনের আলোচনা আছে সরকারি মহলেও। বিএনপি সবসময়ই বলে আসছে- কারাগারে খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে গেলে এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। প্যারোল হলে বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে থাকবেন না কি বিদেশে যাবেন এই প্রশ্নও রয়েছে অনেকের মাঝে। কেউ বলছেন, সৌদি যাবেন। কেউ বলছেন, সিঙ্গাপুরে। আবার কেউ কেউ বলছেন ইংল্যান্ডে যেতে পারেন।

সর্বশেষ পহেলা বৈশাখে খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করার পরের দিন (১৫ এপ্রিল) প্যারোল নিয়ে মুখ খোলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, প্যারোলের বিষয়টি বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের বিষয়, দলের নয়।

বাংলা নববর্ষের দিন দলের তিনজন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, অনেকদিন পর বাংলা নববর্ষে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সীমিত পরিসরে আমরা তিনজন দেখা করার অনুমতি পেয়েছি। এ সময় মূলত তার স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও তার মামলার আইনগত দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘প্যারোল আমাদের দলের বিষয় না। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ- এটা একটা বিষয়, আরেকটা তার পরিবারের বিষয়। সুতরাং এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করিনি।’

কেউ কেউ বলছেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) মুক্তির বিনিময়ে বিএনপি সংসদে যাবে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ রকম কোনো ইনফরমেশন আমাদের কাছে নেই।

অন্যদিকে, সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে নমনীয়। তবে সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সমঝোতা হলে খালেদা জিয়াকে প্যারোল দেয়ার পক্ষপাতী বলে জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ৬ এপ্রিল বলেছেন, খালেদার পক্ষ থেকে আবেদন পেলে খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়টি চিন্তা করা হবে। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোল পেতে হলে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হবে।

মূলত এরপর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির সম্ভাবনার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। যদিও বিএনপি নেতারা মনে করেন, ‘জামিনে মুক্তি পাওয়া তার (খালেদা জিয়া) অধিকার।’

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বিশেষ আদালত। কারাগারে থাকা অবস্থায় এই মামলায় হাইকোর্টে তার সাজা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর হয়।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আরেকটি মামলায় তার সাজা হয়েছে সাত বছর। যে মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন, সেটিতে গ্রেফতারের দেড় মাসের মাথায় জামিন মিললেও তার মুক্তির পথে বাঁধ সেধেছে আরও কমপক্ষে ৩৬টি মামলা। যদিও এখন আর মাত্র দুটি মামলায় জামিন পেলই মুক্তি পাবেন বলে জানান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। এখনেও অপেক্ষা খালেদার মুক্তি কোন পথে তা দেখার।

জামিন নিয়ে খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে একের পর এক মামলায় আটকে রেখেছে। আমরা জাজকোর্টে বেইল পেলে হাইকোর্টে আটকায়। হাইকোর্টে বেইল পেলে সুপ্রিমকোর্টে এভাবে কালক্ষেপণ করে অন্ধকার কারাগারে রেখে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’

তিনি জানান, আইনি প্রক্রিয়ায় তার জামিন পাওয়া কঠিন হবে সরকারের বাধার কারণে। এখনও তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। সাজার চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্ট্র মামলা। দুটি মামলা যদি জামিন পান এবং আর কোনো মামলা করা না হয় তা হলে জামিনে মুক্তি পেতে পারেন। যদি সরকার বারবার বাধা সৃষ্টি না করে তাহলে জেল থেকে মুক্তি মিলতে পারে খালেদা জিয়ার।

প্যারোল নিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি- প্যারোলের বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয়। এখানে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) প্যারোলে যাবেন কি-না, সরকার প্যারোল দিবেন কি-না। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। প্যারোল চাইলে সরকার যদি দেয় তবেই প্যারোলের বিষয়টি আসে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিনিও প্যারোলে গিয়েছিলেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও গিয়েছেন। পাকিস্তানেও দিয়েছে, ইন্ডিয়ায় ললিতাকেও দিয়েছে। প্যারোল রাজনৈতিক ব্যাপার আমরা আইনি বিষয়টি মোকাবেলা করবো।’

তিনি বলেন, ‘খালেদার মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি নিতে আমরা আইনিভাবে মোকাবেলা করব। আশা করি, যদি সরকার বারবার মামলা না দেয় তাহলে মুক্তি মিলবে।’

খালেদার প্যারোল নিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন আরও বলেন, ‘প্যারোলটা কোনো আইনগত ব্যাপার না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার, আর যিনি নেবেন তার।’

খালেদার প্যারোল বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, প্যারোল একটি প্রশাসনিক বিষয়ক এবং এটা আদালতে আসে না কোর্টেও এ বিষয়ে কখনও সিদ্ধান্ত দেয় না। যদি কেউ প্রশাসনিকভাবে প্যারোল চায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। আইনে এর ব্যাখ্যা আসে না। যদি কেউ প্যারোল চায় সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। কাজেই প্যারোলের বিষয়টি কখনও আইনি ব্যাখ্যা দেয়া হয় না। যদিও আইনের ব্যাখ্যায় প্যারোল কখনও উঠেনি।

খালেদা জিয়া প্যারোল পেতে পারেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্যারোল পেতে পারেন কি-না সম্পূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। প্যারোল আবেদন করবেন কি-না, করলে কী কী যুক্তি থাকবে, সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কতটুক গ্রহণ করবেন। এটা দুদকের কোনো বিষয় না এখতিয়ারেও নেই। এটা পুরো পুরি প্রশাসনিক ব্যাপার, প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি দেখবে।’

দুদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসনের কারামুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা ও গুঞ্জনের মধ্যেই গত ১ এপ্রিল তার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রাজি হওয়ায় ওই আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। কারণ এর আগে বিএসএমএমইউয়ে চিকিৎসার অনুরোধ বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যান করেছেন খালেদা জিয়া।

অবশ্য খালেদা জিয়া প্যারোল পেলে বিএনপির রাজনীতি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দলের একটি অংশ মনে করে। ওই অংশের নেতাদের মতে, প্যারোলে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারলেও রাজনীতি করতে পারবেন কি-না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে।

শর্ত সাপেক্ষে কারামুক্ত হয়ে খালেদা জিয়া বিদেশে গেলে সমঝোতার বিষয়গুলো গোপন থাকবে না বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। ফলে তারা আড়ালে ‘সমঝোতা’ করে খালেদার জামিনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তাছাড়া বিএনপির বেশির ভাগ নেতার ধারণা, প্যারোলের বিষয়ে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া রাজি নাও হতে পারেন। যদিও তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে তৎপরতা রয়েছে। কিন্তু পরিবারের উদ্যোগ নিয়ে নানা সমালোচনাও আছে বিএনপিতে।

খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘কোনো আসামি আবেদন করলে, সরকার প্যারোল দিয়ে থাকেন। যদি কারো নিকটাত্মীয় মারা যায় বা অন্য কোনো কারণেও প্যারোল হতে পারে।’

খালেদা জিয়া প্যারোল চাইলে সরকার দিতে পারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে তিনি জানান, বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে বলেছেন। এটাকে বাঁকা চোখে দেখছে বিএনপি। এটা উচিত না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানবিক দিক থেকে খালেদার প্যারোলের কথা বলেছেন। অথচ ব্যাপারটাক নিয়ে রাজনীতি করতে চাচ্ছে বিএনপি।’

খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসামিদের অসুখ-বিসুখ হলে যেকোনো লোক প্যারোল পেতে পারেন। চিকিৎসার জন্য যদি একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে ওনার (খালেদার) ওপর ডিফেন্ড করে। উনি যদি চান, চিকিৎসার জন্য, জীবন বাঁচানো তো ফরজ। চিকিৎসার জন্য উনি যদি দরখাস্ত করেন তাহলে (উইথ কন্ডিশন) সরকার দিতে পারেন।’

সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘প্যারোল নিয়ে ওনি (খালেদা) তো বলতে পারেন আমি মরে যাব তবুও এই সরকারের কাছে প্যারোলের দরখাস্ত করবো না।’

জামিনের বিষয়ে সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন ‘কোর্টের পাওয়ারটা ডিফেন্ড করছে হাসিনা কি চায়। কাজেই কোর্টের থেকে জামিন হবে না, আমার যা মনে হয়। হতেও পারে, নাও হতে পারে।’

তবে সরকারের কাছে আবেদন করলে প্যারোল দিতে পারে বলে মতামত দেন বিএনপির এই আইনজ্ঞ।

কিন্তু সরকারের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার আরও বলেন, ‘ম্যাডামের দরখাস্ত করবেন কি না তার ওপর নির্ভর করবে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উনি বলতে পারেন, আমাকে প্যারোলের জন্য কেন দরখাস্ত করতে হবে সেটাতো সরকার চাইলে নিজেই দিতে পারে।’

তারাই ( সরকার) চাইলে ওনাকে (খালেদাকে) বাসায় রেখে চিকিৎসার অনুমতি দিয়ে প্যারোল দিতে পারেন বলে মতামত দেন সিনিয়র এ আইনজীবী।

তিনি বলেন, ‘আইনিভাবে প্যারোলটা এন্টায়ারলি (সম্পূর্ণরূপে) নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ওপর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোল চান না তারা।

আরও পড়ুন > খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার বিষয়ে কিছু জানে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের সামাজিক অনাচার চলছে, আইন-শৃংখলা কোনো ধরনের কোনো কিছু নাই, রাষ্ট্রীয় যে অরাজকাত চলছে এ সমস্ত বিষয় থেকে দৃষ্টিকে এড়ানোর জন্য আজকে বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলের আলোচনা। প্যারোলের কোনো আবশ্যকতা নাই। সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে নেত্রী নিয়মতন্ত্রিক পথ অর্থাৎ জামিনে নিয়ে বের হয়ে আসেবেন।’

তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালের ১২ মার্চ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামি পেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে তিনি কারাগারে রয়েছেন। তখন থেকে এখন পযন্ত তিনি যে কারাগারে আছেন রাষ্ট্রের একক একজন ব্যক্তির ইচ্ছায় আছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বেগম খালেদা জিয়ার কারারুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে। আইন যদি তার নিজস্ব গতিতে চলে তাহলে বেগম খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি পাবেন।’

কায়সার কামাল আরও বলেন, ওনার বিরুদ্ধে যে মানহানির মামলা আছে সবগুলোই বেইলেবল ওফেন্স। সেই মামলাতে জামিন দেয় না সরকার। প্যারোলের কোনো অবশ্যকতা ওনার নাই, ওনার যে সাংবিধানিক অধিকার তা থেকে বর্তমান সরকার বঞ্চিত করে রেখেছেন।

তিতি বলেন, ‘উনি একজন রোগী এবং ৭৩ বছর বয়সী, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, এসব বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়ার সাংবিধানিক অধিকার এবং জামিনের হকদার, টোটাল ব্যবস্থাপনাটাই সকারের নিয়ন্ত্রণে আজকের বিচারাঙ্গন। বিশেষ করে আজকে বেগম খালেদা জিয়ারর জামিনের বিষয়টিও।’

প্যারোলের বিষয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে এক সময় ট্রাইব্যুনালে ডিফেন্স টিমের মামলায় লড়াইকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্যারোল একটি সামিয়িক ব্যবস্থা ও যেটার ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আছে। যেমন কারারুদ্ধ আসামি তাৎক্ষণিকভাবে বের হয়ে আসতে পারছেন না। যে সকল আসামি তাৎক্ষণিক জামিন পেয়ে বা খালাস পেয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ নাই। তাদেরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্যারোল দিতে পারে।

এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলাকালীন এবং সাজাপ্রাপ্তরা বিভিন্ন সময় প্যারোলে মুক্তি নিয়েছেন বলেও জানান মো. তাজুল ইসলাম।

ইতিহাসে প্যারোল :

এর আগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তির প্যারোল নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগারে থাকার সময় প্যারোল নিয়েছিলেন। এরপর ১/১১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ ভবনে স্থাপিত বিশেষ আদালতের বিচারের সময় কারাগারে আটক থাকা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই প্যারোলে যাওয়ার নজির রয়েছে। এ ছাড়া প্যারোল নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশ গেছেন।

প্যারোলে মুক্তি নিয়েছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দণ্ড নিয়ে কারাগারে রয়েছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও।

প্যারোল এবং জামিনের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য :

আবেদনের শর্ত :

জামিন হলো কেউ যদি মামলার আসামি হয়ে থাকেন বা আসামি হয়ে আটক হয়ে থাকেন তখন তিনি আদালতে জামিনের আবেদন করতে পারবেন।

অন্যদিকে আসামিকে প্যারোল দেয়া হয় যখন আটক হয়ে কারাগারে আছেন কিন্তু বাইরে এমন কিছু ঘটলো যাতে তিনি বিধি মোতাবেক প্যারোল আবেদনের যোগ্য হন তাহলে তিনি আবেদন করতে পারেন।

প্রশাসনিক অনুমতি: জামিন হয় আদালতের নির্দেশে, কিন্তু প্যারোল হয় প্রশাসনিক আদেশে।

জিম্মায় বা তত্ত্বাবধানে :

জামিন পাওয়া ব্যক্তি বাইরে স্বাধীন থাকবেন। তিনি কোনো আদালত বা পুলিশের জিম্মায় থাকবেন না। অপরদিকে প্যারোল পাওয়া ব্যক্তি পুরো সময় পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকেন।

হাজিরা ও জেল :

জামিনে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তি নির্ধারিত দিনে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হাজিরা দেন। আর প্যারোল পাওয়া ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময় পর পুলিশ কারাগারে নিয়ে আসবে।

যে কোনো কারাবন্দি প্যারোল পেতে পারেন :

যেকোনো ধরনের বন্দি, কয়েদি বা হাজতিকে প্যারোলে মুক্তির জন্য বিবেচনা করতে পারেন সরকার। ব্যক্তির অপরাধের কারণে যে মেয়াদের শাস্তি ভোগরত থাকুন না কেন, সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে (যেমন নিকটাত্মীয়ের জানাজা) তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারেন প্যারোলে মুক্তির জন্য।”

“মন্ত্রণালয় দূরত্ব ও স্থান বিবেচনা করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার আবেদন মঞ্জুর করতে পারেন।”

কত সময়ের জন্য প্যারোল :

প্যারোলের কত সময়ের জন্য সেটি একজন আবেদনকারী কত সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি পাবেন সেটা নির্ভর করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারের ওপর।

প্যারোল কি এবং কাকে দেয়া হয় :

কোনো বন্দি প্যারোল পাবেন এবং প্যারোলের আওতায় তার সময়কাল কীভাবে দেখা হবে – তা নিয়ে একটি নীতিমালা আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এ নীতিমালা অনুযায়ী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ নীতিতে থাকা অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো :

ক. নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনা করে প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করে দিবেন;

খ. নিকটআত্মীয় যেমন বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, সন্তান, আপন ভাই-বোন মারা গেলে প্যারোলে মুক্তি দেয়া যায়;

গ. আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে;

ঘ. প্যারোলে মুক্তি পেলেও সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরায় থাকতে হবে;

ঙ. কারাগারের ফটক থেকে প্যারোলে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিকে পুলিশ বুঝে নেয়ার পর নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই কারাগারে ফেরত দিতে হবে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘মা-বাবা মারা যাওয়া, অসুস্থতা বা বিশেষ কোনো জরুরি কারণে আদালত জামিন দিতে না পারলে সেক্ষেত্রে সরকার কাউকে কনসিডার করে মুক্তি দিলে তাকে প্যারোল বলে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্যারোলে শর্ত থাকতেই হবে, এমন নয়। তবে কী কারণে প্যারোল দেবে সেটি সরকারই বলে দেবে।’