সিবিএন ডেস্ক : প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বদলে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম। যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই পরিবর্তন হচ্ছে সাত বছর পর। আধুনিক ও যুগোপযোগী হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচি। পাল্টে যাচ্ছে সিলেবাস ও বই। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পরিবর্তন করা হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যক্রম।

প্রথম ধাপে ২০২১ সালের জানুয়ারিতেই প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে সব বিষয়ের নতুন পাঠ্যক্রমের বই। ধাপে ধাপে সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রীই নতুন পাঠ্যক্রমের লেখা পাবে। কমে যাবে বেশ কিছু বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের টেক্সট ও কনটেক্সট। নতুন কিছু যুক্ত হবে আবার। শিক্ষাক্রম বদলানোর পুরো কাজটি শেষ হবে আগামী এক বছরে। ১০ এপ্রিল থেকে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কাজ শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘শিক্ষাক্রম রিভিউয়ের কাজ চলছে। এরপর শুরু হবে রিভিশন। আগামী বছরের মাঝামাঝিতে নতুন শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা যাবে। তারপর নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে বই লেখা হবে। ২০২১ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই হাতে পেতে শুরু করবে ছাত্রছাত্রীরা।’

এনসিটিবি সূত্র জানায়, এবার প্রচলিত ‘মুখস্থবিদ্যার’ পরিবর্তে লেখা, পড়া, দেখা, শোনা ও বলাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হচ্ছে পুরো এ শিক্ষাক্রম। যেখানে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেই মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালি ইতিহাসের প্রামাণ্যচিত্র দেখতে ও জানতে পারবে। বইয়ের বোঝা কমানো এবং পাঠদানকে আনন্দদায়ক করার বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে সবকিছু।

পাঠ্যক্রমের এ পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ১০ এপ্রিল সমকালকে বলেন, ‘যুগের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যক্রমও পরিবর্তিত হয়। কাজে লাগানো হয় নতুন জ্ঞান, নতুন প্রযুক্তি, নতুন তথ্য, নতুন শিখন পদ্ধতি। অনেকে বলে থাকেন, পাঠ্যবইয়ে এ অংশটুকু না থাকলে ভালো

হতো। আবার কেউ বলেন, এসব যুক্ত করলে ভালো হতো। সবার মতামত নিয়ে পাঠ্যবই সুন্দর করে সাজানো হবে।’

জানা গেছে, বর্তমানে চালু থাকা শিক্ষাক্রম ২০১২ সালে প্রণীত হয়েছিল। পাঁচ বছর পর পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করার কথা। সে হিসেবে ২০১৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার কথা থাকলেও নানা কারণে সম্ভব হয়নি তা। চলতি মাসে এ কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের আগে ১৯৯৫ ও ১৯৭৬ সালে আরও দু’বার শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়েছিল।

এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক তৎপরতা, কর্মমুখী ও সৃজনশীল দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে নতুন শিক্ষাক্রমে। প্রতিটি শ্রেণিতে শিক্ষার একটি স্তর পেরিয়ে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবার। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, দেশাত্মবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে বার্ষিক ছুটির দিন কমিয়ে শিক্ষাঘণ্টা বাড়ানো এবং জাতীয় দিবসসমূহের ছুটির দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযোগী অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করার পরামর্শ থাকবে। শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে এনসিটিবি এবং ‘মাধ্যমিক শিক্ষা খাত মানোন্নয়ন প্রকল্প’ (সেসিপ) একযোগে কাজ শুরু করেছে।

এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) ড. রিয়াজুল হাসান সমকালকে বলেন, ‘প্রাথমিক স্তরের কারিকুলাম পরিমার্জনের জন্য মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ শেষ করেছি আমরা। সেগুলো এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এরপর শিক্ষাক্রম তৈরি হবে, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও শিখন ফল কী হবে, তা বলা থাকবে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে বই লেখা হবে।’ তিনি জানান, এ বছরের মধ্যে শিক্ষাক্রম তৈরি করবেন তারা। ২০২০ সালে সে অনুযায়ী বই লেখা হবে। ২০২১ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা নতুন পাঠ্যক্রমের পাঠ্যবই হাতে পাবে। ২০২২ সালে প্রাক-প্রাথমিক, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিশুরা। আর পঞ্চম শ্রেণির শিশুরা নতুন পাঠ্যক্রমের পাঠ্যবই হাতে পাবে ২০২৩ সালে। ড. রিয়াজুল হাসান আরও জানান, প্রাথমিকে বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনটি বই এবং তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ?ছয়টি করে বই পড়ানো হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এ বইগুলো বদলে যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ১২টি বই নতুন করে লেখা হবে। জিহাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে উৎসাহ দিতে পারে, এমন পাঠ বাদ যাবে। পাশাপাশি আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার মতো পাঠ সংযোজন-বিয়োজন করা হবে। পাঠ সংযোজনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে শিক্ষার্থীর বয়স ও ধারণক্ষমতা। কোরআন-হাদিসের পাঠে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাড়া অন্য কোনো অনুবাদ গ্রহণ করা হবে না। মাদ্রাসার সব বইয়ে বাংলা একাডেমির বানানরীতি এবং চলিত ভাষার ব্যবহার হবে। এসব বইয়ের পরিবর্তন শুরু হবে ২০২০ সালে। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনবার মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন ও সংশোধনী এসেছে।

এনসিটিবির সদস্য (মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনার কাজও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। দেশের নয়টি অঞ্চলের দুটি করে জেলা নিয়ে মোট ১৮টি জেলায় টিম পাঠানো হয়েছে। তারা জেলার সদর উপজেলা ও দুর্গম একটি উপজেলা বাছাই করে নিয়ে কাজ করছেন। ছোট জেলাগুলোর আটটি ও বড় জেলার ১২টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ২০টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষকদের কাছ থেকে। এর সঙ্গে ঢাকা জেলার ২০টি ও চট্টগ্রাম জেলার ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও মতামত ও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ১৭০ থেকে ১৭৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ মে’র মধ্যে ডাটা স্যাম্পল নেওয়া হবে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাধারণ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বালিকা বিদ্যালয়, বালক বিদ্যালয়, ক্যাডেট কলেজসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তথ্য সংগ্রহের পর তা পর্যালোচনা করা হবে জুলাই মাসে। মতামত নেওয়া হবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েরও। বরেণ্য শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের আগস্ট মাসে ডাকা হবে। সবার মতামত নিয়ে কারিকুলাম তৈরির জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা হবে।

এনসিটিবির এই সদস্য জানান, আগামী ২০২১ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণি, ২০২২ সালে সপ্তম, নবম ও একাদশ শ্রেণি এবং ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা পাঠ্যবই হাতে পাবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩টি বই, নবম-দশম শ্রেণিতে ২৭টি বই ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩৯টি বই পড়ানো হয়। অবশ্য নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ের বই পড়তে হয় না।

অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘সারাবছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৯০ দিন কার্যদিবস পাওয়া যায়। সারা বছর কত মিনিট পড়ানো যাবে সে হিসাব করে রচনা করা হবে প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই।’
সূত্র: সমকাল