নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়েছিল ৫ জন: পিবিআই

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০৮:২৩ , আপডেট: ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০৮:৩১

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় ‘সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে’ রোববার রাতে ফেনীর আদালতে জবানবন্দি দেন দুই আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম
নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় ‘সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে’ রোববার রাতে ফেনীর আদালতে জবানবন্দি দেন দুই আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

মৃত্যুশয্যায় নুসরাত ঘটনাস্থলে একজনকে চম্পা নামে ডাকার যে কথা বলেছিলেন, ওই চম্পা আসলে পপি বলে এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ফেনী পিবিআইর অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান।

দুদিন আগে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেছিলেন, “ওই দিন অন্তত চারজন বোরকা পরে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে অন্তত একজন মহিলা ছিল, এটা নিশ্চিত।”

তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগুন দেওয়ার সময় প্রথমে চারজনের নাম পাওয়া গেলেও তদন্তকালে নিশ্চিত হওয়া গেছে পাঁচজন ছিল। এই পাঁচজনের মধ্যে দুইজন নারী।”

এই দুই নারীরই একজন নুসরাতের মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার ভায়রার মেয়ে পপি বলে জানান ফেনীর পিবিআই কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান, এজাহারে নাম না থাকলেও যাকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় আগেই।

নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের করা মামলায় আসামি হিসেবে আটজনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি বোরকা পরা অজ্ঞাতনামা চারজনের কথা বলা হয়েছিল।

দেহের ৮০ শতাংশে আগুনের ক্ষত নিয়ে পাঁচ দিন লড়ে হার মানতে হয় নুসরাত জাহান রাফিকে

দেহের ৮০ শতাংশে আগুনের ক্ষত নিয়ে পাঁচ দিন লড়ে হার মানতে হয় নুসরাত জাহান রাফিকে

দেহে আগুনের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে থাকার সময় নুসরাত বলেছিলেন, মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে বোরকা পরা কয়েকজন তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মুখ ঢাকা থাকায় তাদের তিনি চিনতে পারেননি, তবে তাদের কথায় একজনকে চম্পা বলে ডাকতে শুনেছিলেন।

গত ৬ এপ্রিল এই ঘটনা ঘটার পর এই ‘চম্পা’ শম্পা নামে কেউ কি না, তা খতিয়ে দেখছিলেন পিবিআই কর্মকর্তারা; অধিকাংশ আসামিকে গ্রেপ্তার এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর এখন তারা নিঃসংশয় যে পপিকেই সেদিন চম্পা নামে ডাকা হয়েছিল পরিচয় আড়াল করার উদ্দেশ্যে।

মনিরুজ্জামান বলেন, “ঘটনার পর সন্দেহভাজন হিসাবে পপিকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার নাম শম্পা কি না, সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে এই পপিই শম্পা। আসামিরা শম্পা নামটি কৌশল হিসাবে ঘটনার সময় ব্যবহার করে, যা নুসরাত শুনে জবানবন্দিতে বলে।”

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর গত ৯ এপ্রিল পপিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতেও নেওয়ার অনুমতিও পেয়েছে পুলিশ।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। ৬ এপ্রিলও তার পরীক্ষা ছিল।

নুসরাতের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি মাদ্রাসায় যাওয়ার পর তার বান্ধবী নিশাতকে ‘ছাদে মারধর করা হচ্ছে’ বলে বোরকা পরা এক মেয়ে তাকে ছাদে যেতে প্ররোচিত করেছিলেন।

 

মনিরুজ্জামান বলেন, “নুসরাতকে ভুয়া খবর দিয়ে ছাদে পাঠানো ওই মেয়েটি ছিল পপি। নুসরাতের পেছন পেছন ছাদে উঠে অন্যদের সহযোগিতা করেছিল সে।”

নুসরাত বলে গেছেন, ছাদে পরে বোরকা পরা চারজন তাকে মামলা তুলে নিতে বলে। তাতে রাজি না হওয়ায় ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, নুসরাতের গায়ে আগুন ধরানোর জন্য কেরোসিন ও বোরকা সরবরাহ করেছিলেন পপিই।

প্রথমে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হলেও সোমবার পপিকেও হত্যামামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

ছাদে পপির সঙ্গে আরও এক নারী এবং শাহাদাত হোসেন শামীমসহ তিন পুরুষ ছিলেন বলে পিবিআই কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, যারা সবাই মিলে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

নুসরাতের মাদ্রাসারই ফাজিলের শিক্ষার্থী শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি নুসরাত হত্যাকাণ্ডে যুক্ত হন বলে পিবিআই কর্মকর্তারা জানান।

নুসরাতের মতো সোনাগাজীর উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামেরই যুবক শামীম। নুসরাতের গ্রামেরই আরেক যুবক ও একই মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র নুর উদ্দিন এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান আসামি।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, শামীম ও নুর উদ্দিন ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজের ‘অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ’। নুসরাতকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ গত ২৭ মার্চ গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এই দুই যুবক।

ডিআইজি বনজ মজুমদার এর আগে জানিয়েছিলেন, ঘটনার দুই দিন আগে নূর উদ্দিন কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করে নির্দেশনা নিয়ে আসেন। এর পর মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে সহপাঠী শামীম, জাবেদ হোসেন, আব্দুল কাদের ও আরেকজনকে নিয়ে বৈঠক করেন নূর উদ্দিন। ওই বৈঠকেই নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা হয়।

এই অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা যৌন নিপীড়নের মামলা প্রত্যাহার না করায় জীবন দিতে হল নুসরাতকে

এই অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা যৌন নিপীড়নের মামলা প্রত্যাহার না করায় জীবন দিতে হল নুসরাতকে

নুসরাতের ভাইয়ের করা মামলায় আসামির তালিকায় প্রথম নামটি অধ্যক্ষ সিরাজের, তারপরই নূর উদ্দিন ও শামীমের নাম।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় মাদ্রাসার ফটকে থেকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের তদারকিতে থাকা নূর উদ্দিনকে শুক্রবার ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আগুন দেওয়ার সময় পপি ও শামীম ছাড়া আর কোন তিনজন ছাদে উপস্থিত ছিলেন, সে বিষয়ে মুখ খোলেননি পিবিআই কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। উপস্থিত অন্য নারীর বিষয়েও এখনি কিছু বলেতে চাননি তিনি।

সোমবার সন্ধ্যায় মো. শামীম নামে ওই মাদ্রাসার এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান মনিরুজ্জামান, যার নাম এজাহারে ছিল না।

তিনি বলেন, আলোচিত এই মামলায় এ নিয়ে এ পর্যন্ত এজাহারভুক্ত সাতজনকে এবং এজাহারের বাইরের সাতজনসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হল।

অধ্যক্ষ সিরাজ, নুর উদ্দিন, শামীম ছাড়া গ্রেপ্তার এজাজারভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম, মাদ্রাসাটির শিক্ষক আফছার আহমেদ, মাদ্রাসাটির ছাত্র জাবেদ হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ।

এজাহারভুক্ত আট আসামির মধ্যে হাফেজ আবদুল কাদের নামে একজন এখনও পলাতক।

পিবিআই কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, “তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। যারা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন, তারা বেশ কয়েকজনের নাম বলেছেন যারা এই ঘটনার আগে ও পরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছে।”

গত শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে বনজ মজুমদার বলেছিলেন, এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট ১৩ জন জড়িত ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “তারা দুটি কারণে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে। এর একটি হচ্ছে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা করে আলেম সমাজকে হেয় করা। আর অপরটি হচ্ছে শাহাদত হোসেন শামীমের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা।”

ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গত ২৬ মার্চ নুসরাতের মা শিরীনা আক্তার মামলা করেছিলেন। পরদিন সিরাজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ওই মামলা প্রত্যাহার করতে নুসরাতকে চাপ দেওয়া হলেও প্রতিবাদী এই তরুণী তাতে সাড়া দেননি বলে ৬ এপ্রিল পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন দেওয়া হয়। শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া নুসরাত ১০ এপ্রিল রাতে মারা যান।

দুই বছর আগে দাখিল পরীক্ষার সময়ও আক্রান্ত হয়েছিলেন নুসরাত। তখন তার চোখে দাহ্য পদার্থ ছুড়ে মারা হয়েছিল। ওই ঘটনায়ও নূর উদ্দিনকে সন্দেহ করা হয়।