আতিকুর রহমান মানিক:
আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ সালের প্রথম দিন। আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকজ ঐতিহ্য বৈশাখ বরন। নানান রঙ্গে, বিচিত্র ঢঙ্গে বৈশাখ বরন বাংলাদেশী সংস্কৃতিরই একটা অনুষঙ্গ। ঐতিহ্যের সাথে তাল মিলাতে কয়েকদিন আগে থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল কেরামত আলীর বউ মলকা বানু। বৈশাখের প্রথম দিনে ঘটা করে পয়লা বৈশাখ পালন করবে, বাসন্তী রং শাড়ী পরে ঘুরবে, পান্তা ইলিশ খাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু (বউয়ের ভাষায়) কাঠখোট্টা টাইপের কেরামত তেমন একটা সাড়া না দেয়ায় এই ঘ্যানঘ্যানানিটা সকাল থেকে অবশেষে প্যানপ্যানানিতে রূপ নিয়েছে। বিয়ের আগের প্রাণোচ্ছল-রোমান্টিক কেরামত এখন কেমন যেন যেন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আসলে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে চারদিকের পরিবেশ পরিস্হিতি দেখে কেমন যেন দো-টানায় ভূগে কেরামত।

বছর ঘুরে আজ আবারো ফিরে এসেছে পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব আজ। এ দিনটা বর্ষবরন, পারষ্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়েই উদযাপন করা হয়। কিন্তু হাল আমলের ঘটা করে বর্ষবরন ও পরবর্তী সারা বছরের কর্মকান্ড নিয়ে কেরামতের মনে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। পয়লা বৈশাখে সবাই যেন “একদিনের বাঙ্গালী” হয়ে যায়, আর সারা বছর আকছারই চলে রকমারী ভিনদেশী সংস্কৃতির অপচর্চা ! কেরামত মনে করে, জাতি হিসাবে আমাদের রয়েছে নিজস্ব সোনালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।

আবহমান বাংলার হাজারো বছরের এ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও পোষাক-পরিচ্ছদের সারা বছর ধার না ধারলেও পহেলা বৈশাখে নববর্ষ বরণের দিন হঠাৎ করেই যেন সবাই এক দিনের জন্য বাঙালী হয়ে যায়। এই একদিন যেন সবার “বাঙ্গালীয়ানা” উপচে পড়ে। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে দেশাত্ববোধক গান গেয়ে ফতুয়া-পাঞ্জাবী পরে ১লা বৈশাখে একদিন পান্তা-ইলিশ খেয়ে বাঙালী সাঁজার চেষ্টা করলেও এটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা বিরাট প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার বটে। কারণ আবহমান বাংলার হাজারো বছরের ঐতিহ্যপূর্ণ লোকজ ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বাদ দিয়ে সারা বছর আমদানী করা বিজাতীয় সংস্কৃতি নিয়েই পড়ে থাকেন অনেকে। তাই দেখা যায়, কাপড় কিনতে গেলে ভিনদেশী জিন্স, ইতালিয়ান সু, কোরিয়ান শার্ট ও ফ্রান্সের পারফিউম-কসমেটিক্স সহ রাজ্যের হাবিজাবি বিদেশী জিনিস চড়া দামে কিনে বড়াই করে। অথচ বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত কাপড় ও গার্মেন্টস সামগ্রী সারাবিশ্বে পরম সমাদৃত। এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানী করে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু মানসম্মত দেশীয় এসব পণ্যের পরিবর্তে “বিদেশী” জিনিসের চাহিদাই বেশী।

ফাস্টফুড শপ এ খেতে গেলে দেশী খাবার বাদ দিয়ে অন্তন, নুডুলস, পিজা, বার্গার ও হটডগ সহ বিদঘুটে নাম এবং স্বাদের বিদেশী খাবার অর্ডার করার হুজুগ দেখা যায়। আব্বা-আম্মা-চাচা-চাচীর বদলে ডেডি-মাম্মি-আংকেল-আন্টি স্থান দখল করে নিয়েছে এখন। টিভি দেখার সময় ভারতীয় চ্যানেল দেখা নিয়ে রিমোট টিপতে টিপতে রিমোটের বারটা বাজে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, ভারতীয় বিভিন্ন সিরিয়াল দেখার জন্য দাম্পত্য কলহের জের ধরে অনেক সংসার ভেঙ্গে গেছে। হাল আমলের ছেলে মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখলে রুচির দৈন্যতা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। যে কাপড়ে যত বেশি তালি-জোড়া দেয়া থাকে তা ততই চড়া দামে বিক্রি হয়, এটা নাকি ফ্যাশন।
চুল কাটার সময় ভিনদেশী বিভিন্ন নায়ক-নায়িকাকে অনুসরণ করে বিদঘুটে ঐ সব স্টাইলে চুল কাটার ফলে অনেককে বানর, হনুমান, ভল্লুক ও কাঠবিড়ালীর মনুষ্য সংস্করণ মনে হয়। ইদানীং আবার বখাটে স্টাইলে চুল কাটা ও লোফার স্টাইলে দাড়ি রাখাও নাকি মহা ফ্যাশন ! আজকাল সব জায়গায় এসব দেখে দেখে চরম বিরক্ত কেরামত আলী।

বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানের সময় বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান-হঁলার পরিবর্তে আলমিরা সাইজের সাউন্ড বক্সে ইংরেজী ও হিন্দিগান বাজে। আর এসব লারে-লাপ্পা গানের তালে তালে মুরুব্বীদের সামনেই ধেই-ধেই করে বেশরম নাচ নাচে তরুণ তরুণীরা। আজকাল এসবও নাকি ফ্যাশন। এভাবেই চলছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা, যেখানে প্রতিক্ষনেই ভিনদেশী (অপ)সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন। চারপাশে সারা বছর এসবইতো দেখে আসছে কেরামত আলী ।

এমতাবস্থায় কেবলমাত্র পহেলা বৈশাখে ঢাক-ঢোল, সানাই বাজিয়ে একদিনের জন্য বাঙ্গালী সেঁজে পান্তা ইলিশ খাওয়ার পর ডায়রিয়া বাধানোর পরদিন থেকেই আবারো ভিনদেশী স্টাইল-সংস্কৃতি অনুসরণ করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য ? পহেলা বৈশাখের সকালে বসে বসে এসবই ভাবছিল কেরামত আলী। কিন্তু এসবোর কোন সমাধানই মাথায় এলনা।

অবশেষে বউয়ের তাড়ায় বাজার করার জন্য বাসা থেকে বের হল সে। রাস্তায় বেরিয়ে কিছুদুর যাওয়ার পর হঠাৎ দেখল, বাঘ-ভাল্লুক, শুকর-কুকুর ও সিংহ-হায়েনাসহ আরো বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের বিরাট একটা পাল এগিয়ে আসছে। হিংস্র ও মাংসাশী এসব পশুকে রাস্তায় দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। পৈত্রিক প্রাণটা বাঁচাতে উচ্চঃস্বরে মুসিবতের দোয়া পড়ে পিছন দিকে ভো-দৌঁড় দিয়ে পাশের গলিতে ঢুকে গেল কেরামত আলী। একদম নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে পেছন ফিরল সে। ভাল করে খেয়াল করার পর অবাক হয়ে দেখল, এরা আসলে সবাই মানুষ। বাঘ-ভাল্লুকের মুখোশ লাগিয়ে মিছিলে বের হয়েছে, তাই জন্তু-জানোয়ার মনে করে ভয় পেয়েছিল ভিতু কেরামত আলী। কয়েকজন বলল, এটা নাকি “মঙ্গল শোভাযাত্রা”! মঙ্গল যাত্রার মত একটা শুভ কাজে জন্তু-জানেয়ারের কিম্ভুতকিমাকার বিকট মুখোশগুলো না লাগালে কি এমন ক্ষতি হত?

আর একটা ব্যাপার শুনে আসছিল কেরামত আলী। পয়লা বৈশাখে পান্তা ইলিশ নাকি খেতেই হবে। এ রেওয়াজটা চালু হওয়ার নেপথ্য কাহিনী না জানলেও বিভিন্ন হোটেলে দেখা গেল বেশ ভীড়। আজ বিভিন্ন দামের পান্তা-ইলিশের প্যাকেজ ছেড়েছে হোটেলওয়ালারা। সাথে নাকি কাঁচা মরিচ ও আলুভর্তা ফ্রি ! অল্পটুক পান্তাভাতের সাথে ছোট্ট একটুকরা ইলিশ দিয়ে ৩/৪ শ টাকা নিয়ে নিচ্ছে এরা। কয়েকটি হোটেলতো পান্তা ইলিশের প্রি-পেইড সিষ্টেম চালু করেছে৷ আগে টাকা পরে পান্তা ইলিশ! আবার তারকা মানের কয়েকটি হোটেলে আরো আলীশান কাজ-কারবার৷ সেখানে পান্তা ইলিশের প্যাকেজ নাকি দেড় দুই হাজার টাকা ! কিন্তু আজ কেমন যেন ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছা হলনা কেরামতের। তাই পান্তা ভাতের সাথে লইট্টা মাছ অর্থাৎ “পান্তা-লইট্টা” অথবা পান্তা ভাতের সাথে চিংড়ি (ইছা মাছ) অর্থাৎ “পান্তা ইছা” আছে কিনা জিঞ্জেস করায় রীতিমত বেজার হল হোটেল ওয়ালারা।

আজ অনেককেই দেখা গেল সাদা ধুতি ও ফতোয়া পরা অবস্হায়। কয়েকজনের কাঁধে আনাকোরা নতুন গামছাও দেখা গেল। অথচ এরা সারাবছরই শার্ট-প্যান্ট, কোট-টাইয়ে কেতাদুরস্ত থাকেন। কিন্তু আজ নাকি শতভাগ বাঙ্গালী সাজতে হবে। না হলে বাঙ্গালীয়ানা জাহির হবেনা।
সারাবছর ভিনদেশী সংস্কৃতি অনুসরন করে পয়লা বৈশাখে একদিনের বাঙ্গালীয়ানার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেনা মাথামোটা কেরামত আলী। তাই বাংলা নববর্ষের বৈশাখী আনন্দকে বৈশাখী ঝামেলা মনে করে সে।

হাজারো বছরের সোনালীঐতিহ্যে লালিত আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতিগুলো আজ বিলুপ্ত প্রায়। আমাদের রয়েছে সোনালী অতীত, গৌরবময় ঐতিহ্য। কিন্তু এসব বাদ দিয়ে আজ কোন পথে ছুটছে আমাদের যুবক-যুবতীরা ? প্রতি পয়লা বৈশাখে, বাংলা নববর্ষের দিনে শিকড়সন্ধানের পথে, নিজ উৎসমুখেই কি আমরা হাঁটতে পারিনা ?
কেরামত আলী স্বপ্ন দেখে।
“কষ্ট যাক আসুক হর্ষ, শুভ হোক নববর্ষ”।
সদ্য শুরু হওয়া বছরটা কাটুক পরম মাঙ্গলিকতায়, বৈশাখী শুভেচ্ছা সবাইকে।

আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী
চীফ রিপোর্টার
দৈনিক আমাদের কক্সবাজার ।