শাহিদ মোস্তফা শাহিদ, সদর:
জেলার এককালের সনামধন্য ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতন। বছরের পর বছর শিক্ষকদের অন্তঃকোন্দল, স্কুলের কমিটি নিয়ে গোজামিল, বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়মস নানা অভিযোগে ধ্বংসের পথে হাঁটতে শুরু করেছে এই স্কুলটি।
ইতোমধ্যে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বেশ তুলকালাম কাণ্ড গিয়েছে। একই কাণ্ড অব্যাহত একজন সহকারী শিক্ষককে ঘিরে। সব মিলিয়ে খুব বেশী ভাল যাচ্ছেনা ঐতিহ্যেঘেরা কিশলয়ের। বদনাম শোনা যাচ্ছে লোকমুখে।
সম্প্রতি একজন শিক্ষককের বিরুদ্ধে রাতের অন্ধকারে পোষ্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে অফিস সহকারী ও অপর এক শিক্ষকের উপর হামলা, মারধর, লাঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে।
এর জেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্রাবাস বন্ধ করে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।ফলে সেখানে অবস্থানরত শতাধিক শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষক ও অফিস সহকারীর উপর হামলা এবং মারধরের অভিযোগ এনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে লিখিত আবেদন করলেও এ পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি।
ম্যানেজিং কমিটি এবং শিক্ষক মহলের পক্ষ থেকে দফায় দফায় অভিভাবকদের সাথে বৈঠকে করেও সুষ্ঠু সমাধান করতে পারেনি তারা। বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানিয়েছেন, বৈঠকে ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকদের কাছে সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে প্রকাশ্য ক্ষমা চাইলেও খোলে দেয়নি ছাত্রাবাস। যার কারনে ফুঁসে ওঠেছে অভিভাবক মহল।
ছাত্রবাস বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম বলেন, বহিরাগত কিছু লোক ছাত্রাবাসে ঢুকে স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়-এমন কাজ করছে। নিজস্ব এজেন্ডায় হোস্টেলের ছাত্রদের ব্যবহার করছে। ইতোমধ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে। তাই নিরাপত্তাজনিত কারণে আপাততঃ ছাত্রবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সরেজমিনে খুটাখালী গিয়ে সচেতন এলাকাবাসী, প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২৬ মার্চ রাতে স্কুলের আঙ্গিনায় ইংরেজি শিক্ষক ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে কে বা কারা কুরুচিপূর্ণ কথা লিখে পোষ্টার লাগিয়ে দেয়। পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে অফিস সহকারী এস এম সেলিম উদ্দীন জানালার খোলার সময় নোটিশ বোর্ডের সামনে দেখতে পান বিশ্রি পোষ্টার।
তাঃক্ষণিক বিষয়টি তিনি প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলামকে অবগত করেন।তখন বিদ্যালয়ে পৌঁছে সহকারী প্রধান শিক্ষক বাহাদুর হক, সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান। এসে প্রথমে প্রধান শিক্ষকের অফিসের সামনে দাড়ান দুই শিক্ষক।
অফিস সহকারী সেলিম উদ্দীন মুঠোফোনে কথা শেষ করে উপস্থিত দুই শিক্ষককে জানান যে পোষ্টারের ভাষাগুলো খুবই নোংরা। পরক্ষণেই স্কুলে আসে শিক্ষক ওবায়দুল হক, এসে ছাত্র ও বহিরাগত কয়েকজন লোক ডেকে এনে। পরে অফিস সহকারী সেলিমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে করে পোষ্টারগুলো দেওয়াল থেকে তুলতে থাকে এবং শিক্ষক মিলনায়তনের দিকে চলে যায়। গালিগালাজের বিষয়টি সেলিম তাৎক্ষণিক উপস্থিত দুই শিক্ষককে অবহিত করেন। তারপর মোবাইলে অবগত করেন প্রধান শিক্ষককে।
পরপরই শিক্ষক ওবায়দুল হক অফিস সহকারী সেলিমকে পিছন থেকে লাথি মারেন। সে সময় মাঠে খেলারত কয়েকজন ছাত্র সেলিমকে রক্ষা করে। উভয়ের মধ্যে পুনরায় তর্কতর্কি শুরু হয়। তাকে কেন লাথি মারা হয়েছে মর্মে প্রতিবাদ করেন সেলিম। এসময় আবারো হাতাহাতি সৃষ্টি হলে স্কুলে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং শিক্ষক ওবায়দুল হকের উপর হামলার চেষ্টা চালায়। ছাত্রদের অবস্থা বেগতিক দেখে শিক্ষক ওবায়দুল হককে কৌশলে সরিয়ে দেয় উপস্থিত দুই শিক্ষক।
অভিযোগ উঠেছে উক্ত ইংরেজি শিক্ষক ওবায়দুল হক ইতিপূর্বে ৫/৬ জন শিক্ষকের উপর হামলা, মারধর ও লাঞ্চিত করেছে।যদিও বা পরিচালনা কমিটির কাছে মুছলেকা দিয়ে পার পেয়ে যায়।প্রতিদিন কোন না কোন শিক্ষক, কর্মচারী তার হাতে লাঞ্চিত হয় বলে ভুক্তভোগী কয়েক শিক্ষক জানায়।ঘটনার ১০/১২ দিন আগেও বার্ষিক ক্রীড়া সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় গ্রুপ ভাগ করার জন্য স্কাউট শিক্ষক মোহাম্মদ হোসাইন ও সহকারী শিক্ষক রমিজ উদ্দীনকে সর্ব সম্মতিক্রমে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নির্ধারিত দিনে নবম শ্রেণী থেকে ৪ জন শিক্ষার্থী আনার জন্য বলেন।শিক্ষক রমিজ ৪ শিক্ষার্থীকে বাঁচাই করেন এবং ক্লাসে গিয়ে তাদেরকে ডেকে আনার জন্য যায়।এ সময় ক্লাসে থাকা শিক্ষক ওবায়দুল হকের অনুমতি নিয়ে বাঁচাইকৃত ৪ শিক্ষার্থীকে আনতে চাইলে বাঁধা প্রদান করেন।বার বার বলার সত্বেও আনতে না দেওয়ায় রমিজ ও ওবায়দুল হকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সামনে রমিজ উদ্দীনকে উপর্যপুরী মারধর করে শিক্ষক ওবায়দুল হক। শিক্ষার্থীরা রমিজকে উদ্ধার করে অফিস কক্ষে নিয়ে যায়, তিনি বিষয়টি তাৎক্ষণিক ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের জানালে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে অভিভাবক সদস্য মুজিবুর রহমান।তিনিসহ শিক্ষক প্রতিনিধি, পাশের ক্লাসের অপর এক শিক্ষককে নিয়ে ঘটনাস্থল ক্লাস রুমে গিয়ে তদন্ত করেন।এ সময় শত শত শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে বলেন রমিজ উদ্দীনের উপর হামলা চালিয়েছে শিক্ষক ওবায়দুল হক। স্বাক্ষ্য গ্রহনের ভিডিওসহ চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষক রমিজ উদ্দীন। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন বলে জানা গেছে।
এই ঘটনার সূত্র ধরে ২৭ মার্চ বিকালে জরুরী মিটিং এ বসেন প্রধান শিক্ষক। ঐ মিটিং থেকে পুর্ব ঘোষণা ছাড়াই ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এ দিন কয়েক ছাত্র ছাত্রাবাস ত্যাগ করে বাসায় ফিরে যায়। পরের দিন তথা ২৮ মার্চ স্কুল ছুটির পর দুরবর্তী এলাকার অপরাপর ছাত্ররা চলে যেতে চাইলে হোষ্টেলের ব্লক শিক্ষক মোহাম্মদ মজিদ তাদেরকে যানবাহনে তুলে দেয়। এরই মধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষক ওবায়দুল হকের অনুসারী ৩০/৩৫ জন ছাত্র খুটাখালী সবুজ পাহাড় এলাকায় মহাসড়কে অবস্থান নেয়। পরে কক্সবাজার মুখি প্রতিটি গাড়ী যানবাহন থামিয়ে হোস্টেলের ছাত্র আছে কি না খোঁজ নেয়।সড়কে অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি চাউর হলে বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থানরত ঘরমুখো ৫/৬ জন ছাত্র সিএনজিযোগে কক্সবাজারের দিকে রওনা দেয়। তাদেরকে নিরাপদে ঈদগাহ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া শিক্ষক জুনাইদকে। তিনি অন্য একটি বাইক নিয়ে তাদের সিএনজির পিছনে হয়ে যাচ্ছিল। এসময় সিএনজিটি থামানো মাত্র ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিক্ষক জুনাইদ তাকে দেখা মাত্র পালিয়ে যায় সড়কে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা। পরে তিনি স্কুলে ফিরে প্রধান শিক্ষককে তাজুল ইসলামকে অবগত করেন এবং অবশিষ্ট শিক্ষার্থীদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরাসরি স্পেশাল সার্ভিস নিয়ে কক্সবাজারের দিকে রওনা দেয় শিক্ষক জুনাইদ।
খবরটি পেয়ে আবারও লোহার রড, হাতুড়ি, হকস্টিক নিয়ে মহাসড়কে অবস্থান নেয় ওবায়দুল হক অনুসারী ছাত্ররা। গাড়ীটি সবুজ পাহাড় এলাকায় পৌছলে সংকেত দেয়। থামানোর সাথে সাথে গাড়ী এবং ছাত্রাবাসের ছাত্রদের উপর হামলা চালায়। অবস্থা বেগতিক দেখে গাড়ী থেকে নেমে আসে শিক্ষক মীর মোহাম্মদ জুনাইদ। নামার পর তার উপর আক্রমণ চালায় ঐ শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তাদের হাত থেকে পড়ে যাওয়া একটি কাঠের লাঠি দিয়ে তাদেরকে ধাওয়া করে। তারা পালিয়ে গেলে ছাত্রদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয় জুনাইদ। পরে তিনি খুটাখালী ফেরার পথে ঘটনায় জড়িত এক ছাত্রকে দেখতে পেয়ে ধরে প্রধান শিক্ষকের হাতে তুলে দেন। প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম ধৃত ছাত্র থেকে স্বীকারোক্তি নিলে ওবায়দুল হকের অনুসারী নবম-দশম শ্রেণীর ১৮ জনের নাম উল্লেখ করেন। পরদিন ঘটনা মিমাংসা করার কথা বলে ঢাকা চলে যায় প্রধান শিক্ষক। সোমবার ঢাকা থেকে এসে ঘটনার কোন সুরাহা করতে পারেনি। ঐ ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান না করে বুধবার ম্যানেজিং কমিটি এবং শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখান থেকেও কোন সমাধান আসেনি, এমনকি গোপনে কয়েকবার বৈঠক করার পরও সমাধান দিতে পারেনি।অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষক তাজুল ইসলাম অভিযুক্ত শিক্ষক ওবায়দুল হকের যোগসাজশে ছাত্রাবাসের নিরীহ ১০/১২ জন ছাত্রকে অভিযুক্ত করে তাদের অভিভাবক মহলকে ডেকে এনে সালিশে বসেন।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, ধৃত ছাত্রের দেওয়া স্বীকারোক্তি মতে ১৮ জন জড়িত ছাত্রের নাম উঠে আসলেও তাদেরকে ডাকা হয়নি এমনকি তাদের কোন অভিভাবককেও ডাকা হয়নি।
প্রধান শিক্ষক অভিযুক্ত শিক্ষক ওবায়দুল হকের যোগসাজশে তার অনুসারী ১৮ ছাত্রকে বাদ দিয়ে নিরহ ১০/১২ জন ছাত্রকে হয়রানি করে যাচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষক অন্য এলাকার হওয়ায় শিক্ষক ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।তারা আরো বলেন,জড়িত ছাত্রদের বাঁচাতে মোটা অংকের টাকার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া কোন কারণ ছাড়া ছাত্রাবাস বন্ধ ঘোষণা করাই শতাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবন নিয়ে বেকায়দায় পড়ছে। সর্বশেষ গত ১০ এপ্রিল নিরহ ১০/১২ জন ছাত্রের অভিভাবককে প্রধান শিক্ষক কৌশলে ডেকে আনেন।পুনরায় বৈঠকে বসেন ম্যানেজিং কমিটি,অভিভাবক, শিক্ষক প্রতিনিধি ও কয়েকজন ছাত্র। সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক অভিভাবক প্রকাশ্যে শিক্ষক ওবায়দুল হকের কর্মকান্ড নিয়ে সমালোচনা করেন। তাকে ভাল পথে আসারও অনুরোধ জানান শামশুল আলম নামের এক অভিভাবক। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও অধ্যবদী ছাত্রাবাস খুলে দেয়নি।
এলাকাবাসী,প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সচেতন সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি জানান, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুন্ন হোক সেটা আমরা আশাকরি না।শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে আরো আন্তরিক ভাবে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানান। তাছাড়া চলমান সমস্যা নিরসন সমাধানের জন্য প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এ ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত শিক্ষক ওবায়দুল হকের মোবাইলে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

তবে স্থানীয় একটি সুত্রে জানা গেছে, ওবাইদুল হক নিয়োগপ্রাপ্ত বৈধ শিক্ষক। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ লেগে আছে। তাকে সরাতে নানামুখি ফন্দি পিখির করে চলছে চিহ্নিত মহলটি। যে কারণে কৌশলে ঘটনাসমূহ করানো হচ্ছে। রাতের আঁধারে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানহানিকর পোস্টার ছাপানো ষড়যন্ত্রের অংশ বিশেষ মনে করছে সাধারণ মানুষ। এসব ঘটনার সঙ্গে স্কুল পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্য ও শিক্ষক জড়িত। তাদের নিভৃত করা না গেলে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে মনে করছে স্থানীয়রা।