অনলাইন ডেস্ক : বৃহস্পতিবার প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দেশটির ১৭তম লোকসভা নির্বাচন। নির্বাচনে এবারও ভোট দিচ্ছে মুসলিমরা। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রে আরও এক পেশে হওয়ার ভয় নিয়ে।

পুরনো দিল্লিতে কয়েকশ’ বছর ধরে নির্ভয়েই ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসলেও এখন রাত হলেই মুসলিমরা কেউ আর একা বের হতে চান না গণপিটুনির ভয়ে। পান থেকে চুন খসলেই গণধোলাই।

দেশের রাজনীতির হালহকিকত নিয়েও জোর গলায় মুখ চালাতে পারেন না। বলতে হলে নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলতে হয়।

দিল্লিতে মেশিনের যন্ত্রপাতির দোকানের মালিক আবদুল আদনান বলেন, ‘এই মুহূর্তেই আমাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হতে পারে এবং কেউই আমাকে বাঁচাতে আসবে না। এমনকি আমার সরকারও এখন আর আমাকে ভারতীয় মনে করে না। অথচ এ আমার বাপ-দাদার দেশ। শত শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় এখানে বাস করে আসছি আমরা। সেই আমাকেই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ।’

বৃহস্পতিবার প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন পুরনো দিল্লির বাসিন্দা কলিমুল্লাহ কাশমি (৩১)। তার একমাত্র ভয়, ফের ক্ষমতায় আসতে পারে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপি।

তিনি বলেন, ‘সব সময় একটা উত্তেজনার পরিবেশ চারপাশে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুধু মুসলিমরা নয়, সংখ্যালঘু কারোরই দুর্ভোগের শেষ নেই। কখন কি হয় তা নিয়ে আমি ভীত ও শঙ্কিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘মোদির ভারতে মুসলিমদের কোনো জায়গা নেই। মুসলিমদের অনেকেই ইস্যুটি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু ক্ষমতাবানদের কান পর্যন্ত সেটা পৌঁছাচ্ছে না।’

গুজরাটের এক আঞ্চলিক নেতা থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বড় সমর্থন নিয়ে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসেন মোদি। নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল ভারতের অর্থনীতির আধুনিকীকরণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের প্রভাব বাড়ানো। এসব প্রতিশ্রুতিতে কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রলেপ দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।

গত পাঁচ বছরে নিজের সেসব প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন। তবে একটি ক্ষেত্রে চরম ‘সফলতা’ দেখিয়েছেন। স্বাধীনতার পর কয়েক দশক ধরে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের যে পরিচিতি ছিল তার কবর রচনা করেছেন তিনি। এখন দুই দশক আগে কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদর্শের যে রাজনীতি তিনি শুরু করেছিলেন তা তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিন্দু কট্টরপন্থা এতটাই প্রবল যে ইতিহাসে আর কখনও এমনটা দেখা যায়নি।

ভারতের লোকসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু। কিন্তু দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই প্রধান পুরুষ প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী দেশকে ধর্মের ভিত্তিতে গড়তে চাননি।

স্বাধীনতার পর প্রথম যে সংবিধান প্রণীত হয়, তাতেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হবে। এত দিন সেই ঐতিহ্য ও মর্যাদা অনেকটাই ধরে রেখেছিল ভারত। বর্তমানে ভারতজুড়ে আজ যে আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ তা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই সৃষ্টি হয়।

মানবাধিকারকর্মী ও উদার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদির অধীনে ভারত এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে হিন্দু-মুসলিম আর উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

দেশটির এক ইতিহাসবেত্তা আদিত্য মুখার্জি বলছেন, ‘মোদি ও তার দলকে সহজ ভাষায় আমরা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বলতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই ফ্যাসিবাদের কথাই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন জওহরলাল নেহরু। তিনি বলে গিয়েছেন, ভারতে কখনও যদি ফ্যাসিবাদ আসে, সেটা আসবে হিন্দু ফ্যাসিবাদের রূপে। তিনি যেটা বলেছিলেন আজ চোখের সামনে তাই ঘটছে।’

গোরক্ষা আন্দোলনের নামে একদল হিন্দুর মৌলবাদীর তাণ্ডব শুরু হয়। গরুর মাংস খাওয়াকে ইস্যু বানিয়ে হত্যা করা হচ্ছে শত শত মুসলিম ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের লোকদেরকে।

গ্রামের গলি থেকে শহরের বড় রাস্তা, বাড়ির উঠান থেকে উপাসনালয় কোথাও আজ নিরাপদ নয়। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে ইন্টারনেট জগতেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবাতাস।