বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফেনীর সোনাগাজী পৌর শহরের আলা হেলাল একাডেমির পাশের সামাজিক কবরস্থানে দাদির পাশেই মাটির কোমল ঘরে শুয়ে আছে নুসরাত জাহান রাফি।

বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) যেখানটায় ছিল হাজারও মানুষের পদচারণা, সেখানে আজ সুনসান নীরবতা। এ নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়েই হয়তো নুসরাত ঘুমাচ্ছে। নুসরাত সৃষ্টিকর্তার পরম যত্নে ওপারে ভালোই আছে। কিন্তু তার স্বজনরা কী ভালো আছেন? তাদের বুকের আগুন কী নিভেছে? কিংবা নেভানো সম্ভব? এসব প্রশ্ন যেনো বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।

শুক্রবার (১২ এপ্রিল) ভোরে ফজরের নামাজের পর কবরস্থানে এসেছিলেন নুসরাতের বাবা একেএম মুসা মানিক ও বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানসহ স্বজনরা। এসময় তারা নুসরাতের বিদেহী আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করেন।

নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান কোনোভাবেই তার বোনকে, বোনের অসহ্য কষ্টের কথা ভুলতে পারছেন না। মৃত্যুশয্যায় বোনের মলিন চেহারা বারবার মনে পড়ছে তার। আর এসময় মনের অজান্তে অঝোরে কেঁদে ফেলেন; পড়ে চোখের পানি। বাবা একেএম মুসা মানিকও শোকে পাথর হয়ে আছেন।

স্ত্রী ও সন্তানদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাকে একটু শক্ত থাকতে হলেও নিজেকে তিনি সামলে নিতে পারছেন না। বারবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তিনি বলছেন, আল্লাহ যেনো আমার মেয়েকে মাফ করে নেয়, কবুল করে নেয়। এটাই ফরিয়াদ।শোকে স্তব্ধ হয়ে আছেন নুসরাতের বাবা একেএম মুসা মানিক, ছবি: বাংলানিউজআল্লাহ যেনো আমার একমাত্র মার কবরটাকে জান্নাতের বিছানা বানিয়ে দেয়। আল্লাহ যেনো তাকে জান্নাতি পোশাক পরিয়ে দেয়। জান্নাতি হিসেবে কবুল করে নেয় দোয়া চেয়েছেন মুসা মানিক।

সকাল ৯টার দিকে নুসরাতের বাড়ি সোনাগাজী উত্তর চর চান্দিয়া এলাকার মেজো মৌলভী বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এখোনও সেখানে শোকাতুর আবহ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মানুষগুলো যেনো বাকরুদ্ধ। মুখের ভাষা যেনো হারিয়ে গেছে সবার। নুসরাতের মা ধার্মিক ও পর্দানশীন হওয়ায় তার দেখা না মিললেও বাড়ির অন্য নারীরা জানান, ওর মা শিরিন মেয়ের শোকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো কথাই বলতে পারছেন না। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে পাগল প্রায়।নুসরাতের শোকাতুর খালা সকিনা বেগম, ছবি: বাংলানিউজনুসরাতের দুঃসম্পর্কের খালা সকিনা বেগমও কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, নুসরাতের মা কখনো যদি বাড়ির বাইরে যেতেন, তাহলে মেয়েকে আমার কাছেই রেখে যেতেন। মেয়েটা অসম্ভব ভালো ছিলো। নিষ্পাপ মেয়েটাকে কেনো ওরা পুড়িয়ে মারলো। আমাকে কে এখন খালা বলে ডাকবে।

এদিকে, নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। বিকেল ৫টায় ফেনী ট্রাংক রোড শহীদ মিনারে ‘আমরা ভালোর সঙ্গে (আভাস)’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজক উৎফল সুজন এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে আহবান জানান। এছাড়া প্রতিবাদ অব্যাহত আছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।সুনসান নীরবতা নুসরাতের বাড়িতে, ছবি: বাংলানিউজগত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা।

এর আগে মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ এএসএম সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় তারা। পরে আগুনে ঝলসে যাওয়া নুসরাতকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসায় গঠিত হয় নয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড।

সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নত চিকিৎসার জন্য নুসরাতকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোরও পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু সবার প্রার্থনা-চেষ্টাকে বিফল করে বুধবার (১০ এপ্রিল) রাতে চলে গেলো ‘প্রতিবাদী’ নুসরাত।