ডেস্ক নিউজ:

যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে গিয়ে ফেনীর সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষে আরেক দফা হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে। ওসি নিয়ম ভেঙে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুই পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনও নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না। আইনজীবীরা বলছেন, যৌন হয়রানির অভিযোগ করার সময় ওসির ভিডিও ধারণের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে নুসরাতের পরিবারের। ওসির এ ধরনের আচরণের বিষয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলছেন, আইন না মেনে অভিযোগ করতে যাওয়া কারোর ভিডিও করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।

ভিডিও করার সময় নুসরাত অঝোরে কাঁদছিলেন এবং তার মুখ দু’হাতে ঢেকে রেখেছিলেন। তাতেও ছিল ওসির আপত্তি। বারবারই ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনও তোমাকে কাঁদতে হবে।’

দায়িত্বে অবহেলার দায়ে গত ৯ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কে এই ভিডিও করেছিল প্রশ্নে সোনাগাজী থানার ওসি (তদন্ত) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আজকে অনেকে বিষয়টি জানতে চেয়ে ফোন করায় আমি জানতে পেরেছি।’

ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ভেতরে নুসরাতকে জেরা করা হচ্ছে—‘কিসে পড়া? ক্লাস ছিল?’ ঘটনা জানাতে গিয়ে নুসরাত বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। সে সময় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়—‘কারে কারে জানাইসো বিষয়টা?’ নুসরাত যখন জানায় তাকে অধ্যক্ষ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তখন প্রশ্ন করা হয়—‘ডেকেছিল, নাকি তুমি ওখানে গেছিলা?’ পিয়নের মাধ্যমে ডেকেছিল বলে নুসরাত জানালে প্রশ্ন করা হয়—‘পিয়নের মাধ্যমে ডেকেছিল? পিয়নের নাম কী?’ নুসরাত সে সময় পিয়নের নাম বলেন—‘নূর আলম।’

পুরো ভিডিও’তে নুসরাত কাঁদছিলেন। একসময় ভিডিওধারণকারী তাকে ধমকের সুরে বলে—‘কাঁদলে আমি বুঝবো কী করে, তোমাকে বলতে হবে। এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে কাঁদতে হবে।’

ভিডিও’র শেষে নুসরাতের কথা বলা শেষ হলে ধারণকারী বলেন—‘এইটুকুই?’ আরও কিছু অশালীন উক্তির পাশাপাশি তাকে উদ্দেশ করে ওই ব্যক্তি বলেন—‘এটা কিছু না, কেউ লিখবেও না তোমার কথা। আমি আইনগত ব্যবস্থা নেবো। কিছু হয়নি। রাখো। তুমি বসো।’

যৌন হয়রানির অভিযোগ করার ভিডিও ধারণের বিষয়ে ওসির বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওসি কর্তৃক ভিডিও করা তো দূরে থাক, তাকে হেনস্তামূলক কোনও প্রশ্ন করার অধিকারও ওসির নেই। যদি অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনে মনে হয়, মামলাটি নেওয়ার মতো তাহলে সে মামলাটি নেবে। আর ওসি মামলা না নিলে অভিযোগকারী কোর্টে গিয়ে মামলা (নালিশ) করবেন।’

তিনি বলেন, “হয়রানির শিকার নুসরাতের ভিডিও ধারণ করার ঘটনাটি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২৬ ধারা অনুসারে ফৌজদারি অপরাধ। এখন নুসরাতের পরিবার যদি মনে করে, তবে সংশ্লিষ্ট ওসি’র বিরুদ্ধে ওই ধারায় মামলাও করতে পারবেন।”

পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি কোনও রূঢ় অশালীন উপায়ে সুনির্দিষ্ট আইনিপন্থা না মেনে এ ধরনের কোনও ভিডিও করা হয়ে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। এটি তার ব্যক্তিগত বিচ্যুতি।’

প্রসঙ্গত, নুসরাত জাহান রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিমের পরীক্ষার্থী। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এর আগে তাকে যৌন নিপীড়ন করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অধ্যক্ষকে গ্রেফতারের পর মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।

গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এ সময় তাকে কৌশলে একটি বহুতল ভবনে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে তার গায়ে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাত মারা যান।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনার পর গত ৮ এপ্রিল তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে সোনাগাজী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১০।

আসামিদের মধ্যে পলাতক রয়েছে—সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলম, অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম সহযোগী নূরউদ্দিন, ওই মাদ্রাসার ছাত্র সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হাসান ও আব্দুল কাদের।