ডেস্ক নিউজ:
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা ছাড়াও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে রয়েছে আরও নানা অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফি ছাড়াও সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আরও অনেক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে। ওই মাদ্রাসায় গ্রুপিং, মাদ্রাসার অর্থ তছরুপের অভিযোগের পাশাপাশি মাল্টি-পারপাস কোম্পানি খুলে অর্থ আত্মসাৎ, অন্য একটি মাদ্রাসা গড়ে চেক জালিয়াতি ও নাশকতার অভিযোগে মামলাও আছে তার নামে। এর মধ্যে পাঁচ মামলায় বেশ কয়েক বার জেলও খেটেছে সিরাজ।

সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, অভিভাবক কমিটির সদস্য ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা জানান, আশির দশকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতির মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হয় সিরাজ-উদ-দৌলা। সে জামায়াতের রুকন ছিল। ২০০১ সালের শুরুর দিকে সে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেয়। ২০১৬ সালের দিকেও তাকে জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে দেখা যেতো। তবে পরবর্তী সময়ে তাকে আর জামায়াতের সভা-সমাবেশে দেখা যায়নি। ওই সময় থেকেই সে মূলত ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তোলে।

কয়েকজন অভিভাবক জানান, চলতি বছরই সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অন্য এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মাদ্রাসার সভাপতির কাছে লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়। কিন্তু সে অভিযোগ স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে ধামাচাপা দেয় সিরাজ-উদ-দৌলা।

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন অভিভাবক অভিযোগ করেন, যখনই সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ‘অপকর্মে’র অভিযোগ উঠতো, তার কাছ থেকে কিছু ‘সুবিধা’ নিয়ে ওই সব অভিযোগ ধামাচাপা দিতো মাদ্রাসা কমিটির সহ-সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন।

সোনাগাজী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মান্নান বলেন, ‘সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের আগে ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের সালামতিয়া মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কৃত হয় এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা। ওই মাদ্রাসার এক শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তারও আগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তাকে নোয়াখালীর বসুরহাটের রঙ্গমালা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।’

ফেনী কোর্টের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘মাল্টি-পারপাস কোম্পানি খুলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার নামে মামলাও হয়। এ মামলা ছাড়াও আরও কমপক্ষে চার মামলায় গ্রেফতারও হয় সে। এর মধ্যে ফেনী মডেল থানায় দায়ের হওয়া একটি নাশকতা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সে। সোনাগাজী থানায় দায়ের হওয়া দুটি ও আদালতে হওয়া আরও এক মামলায় সে জেল খাটে।’

বিস্ময় প্রকাশ করে এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘এমন একটা অপরাধী কীভাবে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের চেয়ারে এতোদিন থাকলো, চিন্তার বিষয়।’

সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অভিভাবক কমিটির সদস্য আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদ্রাসায় নিয়োগ পাওয়ার পর একদল সুবিধাবাদীদের নিয়ে অনিয়মের মহোৎসবে মেতে ওঠে সিরাজ-উদ-দৌলা। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে সে সখ্যতা গড়ে তোলে। মাদ্রাসায় বখাটেদের নিয়ে একটি বাহিনীও গড়ে তোলে। নানা সময়ে মাদ্রাসার বিভিন্ন তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে, কিন্তু প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে সে পার পেয়ে যায়। একাধিকবার তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তার অভিযোগও উঠে। কিন্তু প্রভাবশালীদের কাজে লাগিয়ে সেসব অভিযোগ সে ধামাচাপা দেয়।’

তিনি বলেন, ‘সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় সে ফেনী শহরে উম্মুল কুরা মাদ্রাসা নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ওই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার-হোল্ডারদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে চারজন শেয়ার-হোল্ডার তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলাও করেন।’

প্রায় একই ধরনের কথা জানান সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন। তিনি বলেন, ‘১৮ বছর ধরে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আছে সিরাজ-উদ-দৌলা। এর আগেও একাধিকবার তার বিরুদ্ধে অনেক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। প্রায় প্রতিবারই প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে তা ধামাচাপা দেয় সে। অপকর্ম আড়াল করতে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার অর্থ তছরুপের অভিযোগে রয়েছে। মাদ্রাসা ঘিরে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়ারও অভিযোগ আছে।’

সোনাগাজী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ আবদুল হালিম মামুন বলেন, ‘এর আগে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তথ্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এনামুল করিমকে জানিয়েছি। কিন্তু তিনি কোনও ব্যবস্থা নেননি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় দুটি গ্রুপ আছে। একটি গ্রুপ সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষে সব সময় অবস্থান নিতো। আর অন্য পক্ষটি তার বিরুদ্ধে কাজ করতো। নুসরাত জাহান রাফির বিষয়টি জানাজানির পর দুই গ্রুপ পক্ষে-বিপক্ষে কর্মসূচি পালন করে।’

এ ব্যাপারে মাদ্রাসা সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিকে এনামুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদ্রাসার দায়িত্ব নেওয়ার পর অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছিল, এটি সত্য। কিন্তু এগুলো যাছাইবাছাই করাটা আমার পক্ষে কঠিন ছিল। তারপরও আমি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু এক্ষেত্রে অন্য কারও সহযোগিতা পাইনি। এখন তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

 

প্রসঙ্গত, ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় নুসরাত বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান।

গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে বোরকা পরা ৪-৫ ব্যক্তি তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য, ভুক্তভোগী মাদ্রাসাছাত্রী সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরছান্দিয়া গ্রামের মাওলানা একেএম মানিকের মেয়ে। অভিযোগ আছে, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এর আগে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করে। এ কারণে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় মেয়েটির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা বর্তমানে ফেনী কারাগারে আছেন।

এদিকে, সোমবার (৮ এপ্রিল) দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার সর্বশেষ স্বাস্থ্যের অবস্থা জানিয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়। মঙ্গলবার সকালে সেখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন ডা. সামন্তলাল সেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মেয়েটির শারীরিক যে অবস্থা তাতে পাঁচ ঘণ্টা ফ্লাই করা খুবই রিস্কি বলে মনে করছেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তাই এই মুহূর্তে মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া সম্ভব না।’