ছবি সংগৃহীত

জালাল আহমদ :
ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়। পবিত্র কুরআন শরীফের স্পষ্ট বাণী ” প্রত্যেক প্রাণী কে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে”। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে মানুষের কর্মই মানুষকে মহৎ করে তুলে। আমার বয়স যখন ৫-৬ বছর, তখন আমার বাবা মারা যায়। আমার কনিষ্ঠ ভাই আবু সালেহ তখন মাত্র এক বছর। তখনও আমি জন্ম – মৃত্যু কি জিনিস তা বুঝতাম না।বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মা পুরো পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন। মা, ফুফু এবং চাচাদের কাছ থেকে শুনেছি ” আমার দাদা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা পুরো পরিবারকে আগলে রাখতে গিয়ে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়েছিল”। আমার বাবার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের হাল ধরা, বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করা এবং সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য মায়ের আপ্রাণ চেষ্টা আমি নিজ চোখে দেখেছি। গ্রামে দেখেছি কাক যখন মুরগির বাচ্চাদের ছো মেরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে, তখন মা মুরগি তার বাচ্চাদের বুকের তলে আগলে রাখে। ঠিক তেমনি আমার মা আমাদের পুরো পরিবারকে সেভাবে তার বুকে আগলে রেখে মানুষ করেছেন। আমার মায়ের মত সংসারী মহিলা পৃথিবীতে খুব কমই দেখেছি।বাড়ির ক্ষেত- খামারের কাজ থেকে শুরু করে ছেলেদের পড়াশোনা সবকিছুই মা সামলিয়েছে। আমার এখনো মনে আছে, আমি যখন ২০০২ সালে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি, তখন স্থানীয় একটি বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে বৃত্তি লাভ করি। মা কি খুশি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এর পর মায়ের দোয়ায় আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। চতুর্থ শ্রেণীতে ৩ টি বৃত্তি, ৫ম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তিসহ ২ টি বৃত্তি, ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ৩ টি বৃত্তি, ৭ ম শ্রেণীতে ১ টি বৃত্তি , ৮ ম শ্রেণীতে সরকারি জুনিয়র বৃত্তিসহ ৫ টি, ৯ ম শ্রেণীতে ১ টি বৃত্তিসহ জীবনে অসংখ্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে ফলাফল করি, যার পেছনে ছিল মায়ের দোয়া। ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার সময় আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থ অবস্থায় বিজ্ঞানের গ্রুপভিত্তিক সাবজেক্টগুলোর পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে জিপিএ -৫ অর্জন করি। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ – ৫ পাব তা আমি কল্পনা করি নি।শুধু আমার মায়ের দোয়ার কারণেই মনে হয় আমি জিপিএ -৫ পেয়েছি।মায়ের ইচ্ছা পূরণে ডাক্তার হওয়ার জন্য মেডিকেল কোচিং করেছি। ২০১২ সালে হঠাৎ সরকারের সিদ্ধান্ত ” এ বছর মেডিকেলে কোন ভর্তি পরীক্ষা হবে না। এসএসসি এবং এইচএসসির জিপিএ এর ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজ গুলোতে ভর্তি হবে”। সরকারের হঠাৎ এমন ভুল সিদ্ধান্তে হাজার হাজার মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামে। আমিও সেসময় রাজপথে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে আটক হই। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আমাদের আটকের খবর প্রকাশিত হওয়ায় আমার মা আমি আটক হওয়ার খবরটি জানতে পারে। মায়ের দোয়া এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি পরদিনই মুক্তি পেয়ে যাই।কিন্তু শারীরিক – মানসিক নির্যাতনের কারণে জীবন এলেমেলো হয়ে যায়। মেধা এবং দরিদ্র কোটায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ হলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার এবং লবিং এর কাছে আমার মেধা হেরে যায়। ভাইভার সময় আমার বড় ভাই আবুল কাশেমকে নিয়ে গেছিলাম যাতে পরিবার বুঝতে পারে যে, আমি মেধার ভিত্তিতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক লবিংয়ের কাছে আমার মেডিকেলে পড়ার স্বপ্নের মৃত্যুর হয়। এর পর হতাশাগ্রস্ত মন নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে ভর্তি হয়। ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা মানন্নোয়ন দেওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হয়। অনলাইনে ফরম পূরণের শেষ দিনে আবেদন করি। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ঘ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে ১৬৩৭ তম অবস্থান অর্জন করি। কিন্তু একটি বিশেষ মহল আমাকে বাদ দিয়ে আমার পরিবর্তে ১৭৭২ তম অবস্থান অর্জনকারী এক ছাত্রীকে ভর্তি করালে আমি আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে ধর্ণা দিই। মানবাধিকার সংগঠন থেকে বলা হয় ” আপনি প্রথম আলোতে একটি নিউজ করান। তারপর আমরা রিট করার সময় রিপোর্টসহ আদালতে উপস্থাপন করব। প্রথম আলো পত্রিকা নিউজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ আমার কাছ থেকে ২৪ ঘন্টা সময় নেয়। দীর্ঘদিন ঢাকায় অবস্থান করায় আমার মা আমাকে কল দিয়ে জানতে চাইলেন আমি কেমন আছি।উত্তরে বললাম” মা, কত কষ্টে আছি “?আমার এমন দীর্ঘশ্বাস শুনে মা জানতে ভর্তি প্রক্রিয়ার কি অবস্থা? উত্তরে বলেছিলাম ” মা, ডিন স্যার সময় নিয়েছে ২৪ ঘন্টা ।আপনি দোয়া করবেন যেন দ্রুত সময়ে ভর্তি হয়ে যেতে পারি”। আমি জীবনে অনেক বিপদে পড়েছি।কিন্তু আমার এত দীর্ঘশ্বাস মা কখনো শুনে নি। মায়ের কী দোয়া! পরদিন আমার ভর্তি সম্পন্ন হয়। রাজনৈতিক নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন আমার পরিবার।সেই সময়ে আমার বিরুদ্ধে জটিল মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু আমার মায়ের দোয়ায় আমরা সমস্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হই। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চলে গেলে তা আবার ফেরত পাই। সেই চরম দুঃসময়ে মায়ের দোয়ায় সমস্ত জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হই। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতারা একের পর এক আটক হলে আমি কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছি। আটক নেতাদের মুক্তির জন্য রাজপথে আন্দোলন করেছি। কিন্তু মায়ের অশেষ রহমতে অসংখ্য বার জীবনে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। মাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম ডাকসু নির্বাচনের পর কোন একটা চাকরি করে পরিবারকে আর্থিক সাপোর্ট দিবো। কিন্তু তার আগেই মা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়।এদেশের নিষ্ঠুর রাজনৈতিক নিপীড়ন আমাকে আমার মায়ের সেবা থেকে বঞ্চিত করেছে। ডাক্তার হলে অন্তত মায়ের সেবাটুকু করতে পারতাম। গত ৯ এপ্রিল দুপুর ৩ টায় আমার মা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল ফরমালেন। রাতেই পেকুয়া উপজেলার শিলখালী দোকান পাড়ায় কবরস্থানে মাকে সমাহিত করি। আমার মা ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক,যার কাছ থেকে নীতি -নৈতিকতা শিক্ষা লাভ করেছি।সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হয় তা মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। মহান আল্লাহ আমার মাকে বেহেশতের শ্রেষ্ঠ স্তর জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। সবার কাছে আমার মায়ের পরকালে মুক্তির জন্য দোয়া কামনা করছি।
লেখকঃ ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।