শাহিদ মোস্তফা শাহিদ,কক্সবাজার সদর :

সারাদেশে লবনের চাহিদা মেটাতে প্রচন্ড গরম ও রোদে পুড়ে কক্সবাজার জেলার সাড়ে ২৭ হাজার চাষীরা প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করলেও কুচক্রী মহলের লবণ আমদানী,দফায় দফায় কালবৈশাখী, দরপতনের কারণে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত এবং ঘুরে দাড়াতে পারছে না প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাষীরা। ঢাকা -নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-খুলনার মিল মালিকরা অর্ধলক্ষ লবণ চাষীর ভাগ্য নিয়ে আবারো ছিনিমিনি খেলায় মেতেছে, অভিযোগ করে লবণ শিল্প বাচাও সমিতির নেতৃবৃন্দরা।

মাঠ পর্যায়ে চাষিরা ৪০ কেজি লবণ বিক্রি দর পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩শ’ টাকা। যা হিসাব করলে প্রতি কেজির মূল্য দাড়ায় মাত্র সাড়ে ৭ টাকা। অথচ কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদিত লবণ ক্রয় করে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো প্রতি কেজি প্যাকেট জাত লবণ বিক্রি করছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

প্রাকৃতিক বৈরী আচরণের কারণে গেল বছর লবণ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় অজুহাত দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানী করেছে বেশির ভাগ মিল মালিক কতৃপক্ষ। তাদের গুদামে এসব বিদেশী লবণ এখনো মওজুদ আছে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া কর ফাঁকি দিয়ে চীন থেকে চোরাই পথে প্রবেশ হচ্ছে সোডিয়াম সালফেটন ও ক্লোরাইড নামের খাবারের লবন। যা মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে জানান ইসলামপুর লবন মিল মালিক সমতির সভাপতি শামশুল আলম আজাদ।

এসবের কারনে দেশে উৎপাদিত লবণ কিনতে তারা তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো আয়োডিন মিশ্রিত লবণের নাম দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করলেও সরাসরি লবণ উৎপাদন কাজে জড়িত চাষিদের পেটে ঠিকমত মোটাচালের দু’ বেলা ভাত’ও জোটছে না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এসব প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলো কোটি কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও লবণ চাষিরা কোন ধরণের ব্যাংক ঋণ পায় না বললেই চলে।

তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলেই ওইসব প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো লবণ উৎপাদনের ঘাটতি দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির তোড় জোড় শুরু করবে। বিদেশ থেকে লবণ আমদানী করলেই মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণ মাঠের গর্তেই পড়ে থাকে। গত বছর লবণের বাজার মূল্য ভাল ছিল বলে বেশিরভাগ চাষি লাভের আশায় ব্যাপক লবণ চাষ করেছে এ মৌসুমে ।

সূত্র মতে, দেশের বৃহত্তম লবণ উৎপাদন জোন কক্সবাজারে প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে ২৭ হাজার ৫ শ জন মত চাষী চলতি মৌসুমে লবন চাষ করছে। জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। দেশের এক তৃতীয়াংশ লবণের চাহিদা পুরণ করে কক্সবাজার সদর, চকরি তথা কক্সবাজারের উৎপাদিত লবণ।বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে গত মৌসুম লবণের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকায় দেশের একমাত্র লবন উৎপাদনকারী জেলা কক্সবাজারের প্রান্তিক বেশিরভাগ চাষীরা লাভের আশায় এ মৌসুমে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় চলতি উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমান লবন উৎপাদন হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমান লবণ। তবে এবার লবণের মূল্য কম থাকা, দফায় দফায় কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে চাষীদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। জানুয়ারী মাস থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মে মাসে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। তবে আবারো টানা কালবৈশাখী শুরু হলে নিমিষেই শেষ হবে যে কোন মুহুর্তে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রান্তিক চাষীরা প্রতিকানি লবন মাঠ বর্গা নিয়েছেন সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকায়। তারপর রয়েছে শ্রমিকের বেতন, পলিথিন ক্রয়সহ আনুসাঙ্গিক ১৫ হাজার টাকা খরচ।

গত বছরের এই সময়ে প্রতি মণ লবণের মূল্য ছিল সাড়ে ৫শ থেকে ৬ শ টাকা। কিন্তু মৌসুমে শুরুতেই লবণের দাম ৩শ ৫০ টাকা থাকলেও বর্তমানে ৩শ ১০/১৫ টাকায় নেমে এসেছে । গত সাড়ে তিন মাসে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ মণ। যার আনুমানিক মূল্য ২৭ থেকে ২৮ হাজার টাকা । মৌসুম আছে আর মাত্র এক মাস মত।এতে উৎপাদন হতে পারে আরো ১৩০ থেকে থেকে ১৪০ মণ।

স্থানীয় লবণচাষি জামাল উদ্দিন জানান, গত বছর প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ৫শ থেকে সাড়ে ৬শ টাকায়। এ মৌসুমে শুরুতে মণ প্রতি লবণের দাম ছিল ৩৫০ টাকা, এখন তা ৩শ ১০/১৫ টাকায় নেমে এসেছে তাঁদের আরও অভিযোগ, বিদেশ থেকে আমদানির করা ও আমদানীর গুজব ছড়িয়ে চাষি পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে একটি মহল।

শাহজাহান নামের অপর এক চাষি বলেন, বিগত বছরের তুলনায় এই মৌসুমে লবণের দাম অনেক কম। প্রতিবছর মুলধন ছাড়া প্রতিকানিতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাভ থাকে, আর এ মৌসুমে লাভ তো দুরের কথা মূলধনের নিশ্চয়তা নাই। বর্তমান বাজারদরে লবণ বিক্রি করে দিতে পারছি না শ্রমিকের বেতন, চালাতে পারছি না ঘর-সংসার, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছেলে-মেয়েদের পড়া-শুনা।

উপকূলীয় লবণ চাষী সমিতির এক নেতা বলেন দেশের একমাত্র স্বয়ং সম্পুর্ণ খাতটি ধংস করার জন্য কতিপয় মিল মালিক, এবং দালাল চক্র ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তারা বিদেশ থেকে ক্ষতিকর লবণ আমদানি করে দেশের এই প্রধান উৎপাদন খাতটিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার যড়যন্ত্র চালাচ্ছে, কিন্তু সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে আমরা সবাই এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ আছি। তিনি আরো বলেন,নীতিমালা না থাকার কারণে দেশের অন্যতম স্বনির্ভর লবণ খাতটি এখন হুমকির মুখে পরতে পারে।

এ ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ লবন শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প (বিসিক) কক্সবাজারের উপ-মহা ব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরীর মুঠোফোনে কল করা হয়। রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।