গোলাম আজম খান, দৈনিক নয়া দিগন্ত, কক্সবাজারঃ

গত বছরের মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্দেহভাজন মাদককারবারিদের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তবুও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে মিয়ানমারে। যার অন্যতম একটি মাধ্যম হুন্ডি। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজারেই ৬৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন নিহত হয়েছে বিগত ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে ১০২ জন মাদক পাচারকারী আত্মসমর্পণের আগে। ১৬ জন নিহত হয়েছে আত্মসমর্পণের পরে। পুলিশ জানায়, যারা নিহত হয়েছেন তারা সশস্ত্র মাদককারবারি এবং পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। মাদক কারবার বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া এই অভিযান সর্বমহলে বেশ প্রশংসিত হয়ে আসছে। যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতেই অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে মাদক পাচারকারীরা। নারী, পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে ধরা পড়ছে অনেক রোহিঙ্গা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিন কোথাও না কোথাও অভিযান পরিচালনা করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা, আটক করে কারাগারে পাঠানো বা বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পরও থামছে না পাচারের কাজ। তারা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করেই যাচ্ছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার একদিনেই মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করা ২৩ রোহিঙ্গাসহ ২৬ জনকে ইয়াবাসহ আটক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এদের মধ্যে ১৩ রোহিঙ্গার পেট থেকে শুক্রবার রাতে বের করা হয়েছে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা। রোহিঙ্গাদের পেট ভাড়া করেই চালানো হচ্ছে পাচার কাজ। চালানপ্রতি ২০ হাজার টাকায় মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গার দল পেটে করেই এপারে আনছে ইয়াবার চালান।
কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে ইয়াবা আনা হচ্ছে এমন সংবাদে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মীরা গত শুক্রবার সকালে নাফনদীর তীরে অবস্থান নেয়। এ সময় ইয়াবা বহনকারী সন্দেহে নদী পার হওয়া একদল রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এরপর টেকনাফের হ্নীলা চৌধুরী পাড়ার নাফনদ তীরের একটি ঘরে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মীরা আরো কয়েকজন রোহিঙ্গাসহ মোট ২৬ জনকে আটক করে। তারা সবাই গত শুক্রবার ভোরে মিয়ানমার থেকে নৌকায় এপারে এসে ঘরটিতে আশ্রয় নিয়েছিল। আটকদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশী। অন্য ২৩ জন রোহিঙ্গার মধ্যে দুই নারী ও তিন শিশুকে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এক্সরের মাধ্যমে ১৩ জনকে পেটে ইয়াবা বহনকারী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া ১৩ রোহিঙ্গা থেকে গত শুক্রবার রাত পর্যন্ত পেট থেকে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা বের করেছে। এসব রোহিঙ্গারা অকপটে স্বীকার করেছে, তারা জনপ্রতি এক ট্রিপে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ইয়াবার চালান পাচার করছিল।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ করা ইয়াবা কারবারির তালিকায় এক হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারি রয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা ওই হালনাগাদ তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি এবং বদির তিন ভাই, এক বোন, ভাগ্নেসহ ২৬ জন আত্মীয়ের নাম রয়েছে। আরেক সাবেক সংসদ সদস্যের স্বজনের নামও রয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে টেকনাফে ১০২ জন আলোচিত ইয়াবা কারবারি পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ করে। এরপর সবাই আশাবাদী ছিল, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। কিন্তু কিছুদিন থমকে থাকলেও ফের বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ঢুকছে।
সূত্র জানায়, টেকনাফ-উখিয়ার সীমান্ত মিয়ানমারের সাথে লাগোয়া রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনবসতি হওয়ায় পাচারকারীরা সহজেই ইয়াবা আদান-প্রদান করতে পারে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় অনেকেই রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন রিকশাচালক, দিনমজুর, জেলে, কাঠুরিয়া, জিপচালক, হেলপারসহ আরো অনেক পেশাজীবী। প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি করেছেন প্রাসাদোপম অট্টালিকা। তবে মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে একের পর এক প্রাণহানি ও ইয়াবা প্রাসাদগুলোতে বুলডোজারের আঘাতের পর বাঁচার পথ খুঁজছেন তারা।
এসব ইয়াবা চোরাচালানের কোটি কোটি টাকা মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। ব্যাংক লেনদেনে ঝুঁকি থাকায় টাকা পাচারে এই পথকে বেছে নিয়েছে চোরাচালানিরা। কয়েকজন শীর্ষ ইয়াবা কারবারি জানান, মিয়ানমারে এই টাকা যাচ্ছে দুবাই, সিঙ্গাপুর ঘুরে।
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে লেনদেনে ঝুঁকি থাকায়, কক্সবাজারের ইয়াবা গডফাদাররা দীর্ঘদিন ধরে হুন্ডিকেই ব্যবহার করে আসছে নিরাপদমাধ্যম হিসেবে। খোদ ইয়াবা কারবারিদেরই তথ্য, টেকনাফসহ সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আড়ালে হুন্ডি বাণিজ্য করেই অনেকে রাতারাতি বনে গেছে ধনী। তিন বছর আগে কক্সবাজারে ইয়াবা আর মানবপাচারে জড়িত তিন শতাধিক ব্যক্তির একাউন্ট শনাক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রকারের পদক্ষেপে কোথাও যেন ঘাটতি রয়ে গেছে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই মাদক পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। মাদক পাচার কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হয়। এসব ধাপ চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তারা আরো বলেন, ১০২ জন পাচারকারী আত্মসমর্পণ করেছে। পাচারও বাড়ছে, অভিযানও চলছে। কিন্তু এর প্রভাবটা সেভাবে আসছে না। সামগ্রিকভাবে যে লড়াই চলছে তা এগিয়ে নিতে যেন কোনো ছাড় দেয়া না হয়।
এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক (এডি) সোমেন মণ্ডল বলেন, পাচারকারীরা এতটা ডেস্পারেট হয়ে গেছে যে, মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ অতি লোভের কারণে পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পাচার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন জানান, কোনো অবস্থাতেই মাদক পাচারকারীরা ছাড় পাবে না। তাদের মাদক ছাড়তে হবে, তাদের না হয় কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার হওয়ার প্রধান রুট হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়াকে চিহ্নিত করে পুলিশ। এখান দিয়ে ইয়াবা এসে চলে যাচ্ছে সারা দেশে। গত বছরের ৪ মে থেকে ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক কারবারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে সারা দেশে এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে ৩২৫ জন নিহত হয়েছে।