–  মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী

বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ঢাকার বনানী’র ২৩ তলা আরএফ টাওয়ারের আগুন যখন ধাও ধাও করে জ্বলছিল, আগুনের লেলিহান শিখা যখন আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করছিল-তখন সেখানে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষ ব্যস্ত ছিল ছবি তোলা, ভিডিও করা আর লাইভ দেখানো নিয়ে। অথচ তাদের কেউই গণমাধ্যম কর্মী নন। অথচ তখন শত শত মানুষ আরএফ টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে আটক অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য গগনবিদারী আর্তনাদ করছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এখন যেকোন সময়, যেখানে সেখানে ঘটনা-দুর্ঘটনায়, বিপদে-আপদে বেশীর ভাগ লোকজন জরুরীভাবে সহায়তা নাকরে বিপদে পড়া মানুষের অসহায়ত্ব ও ঘটনার ভয়াবহতাকে পূঁজি করে ছবি উঠানো, ভিডিও ধারণ করা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যেটা নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীলতা, মানবিকতা ও সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

একসময় এমন একটি বাস্তব কাহিনী শুনেছি-ছোট্ট একটা শিশু নাকি কম গভীরতাসম্পন্ন একটি ডোবার পানিতে ডুবে যাচ্ছে, তখন একজন লোক সেটা দেখে ডুবন্ত শিশুটাকে উদ্ধার নাকরে লোকটি তার তীক্ষ্ণ ও উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নতুন উপহার পাওয়া এনড্রয়েড মোবাইল সেট দিয়ে শিশুটির পানিতে একেবারে ডুবে মারা যাওয়ার দৃশ্য মনযোগ সহকারে ধারণ করেছে। কিন্তু লোকটি যদি ছবি ধারণ নাকরে দেখার সাথে সাথে শিশুটিকে ডোবা থেকে উদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করতো, তাহলে হয়তো শিশুটি জীবনে বেঁচে যেতো। এই পৈশাচিক কাহিনীর মতোই আমাদের সমাজে প্রায়শই এরকম ঘটে যাওয়া ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটা মানুষের মহৎ গুনাবলীতে আঘাত হানে। স্বাভাবিক মনুষ্যত্ব লোপ পাওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। ভাবিয়ে তোলে মানবিক গুনাবলীসম্পন্ন মানুষের বিবেক। নির্মমতাকে উৎসাহিত করে।

বৃহস্পতিবারের বনানীর ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাতেও এর ব্যতিক্রম খুব একটা হয়নি। যে অগ্নিকান্ডে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ২৬ জন আদমসন্তান প্রাণ হারানোর খবর পাওয়া গেছে। শতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে, তাদের অনেকে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এরই মাঝে এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে একটি শিশুর প্রানান্ত সহায়তার একটি ছবি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ছবিটি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ছবিটি ঘুমিয়ে পড়া আমাদের মানবিকতা ও মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করেছে। শিশুটির নাম, ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। শিশুটি ফায়ার সার্ভিসের পানির পাইপ ছিদ্র হয়ে পানি বের হয়ে পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ছিদ্রটি পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে হাতে পায়ে সাধ্যমতো চেপে ধরে ছিদ্র থেকে পানি বের হতে দিচ্ছিলনা। যাতে পাইপে পানির স্পীড রাখা যায়, সবটুকু পানি আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা যায়। এরকম ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত কর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেকে প্রাণে বেঁচে গেছে। অনেকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যকে বাঁচিয়েছে, ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করেছে। নাহয়, এ অগ্নিকান্ডে মৃত্যুর মিছিল হয়ত আরো অনেক দীর্ঘ হতো। বিভিন্ন ছবি ও লাইভে এধরনের মানবিক গুনাবলীসম্পন্ন কাজ দেখে আমরা প্রেরনা ও প্রত্যয়ে সমৃদ্ধ হই। স্যালুট! আবারো স্যালুট! এই অবসাদের মাঝেও এরকম দৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায়, ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার গাওয়া সে জনপ্রিয় গান “মানুষ মানুষের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারেনা! ও বন্ধু–“।

নাম নাজানা ঐ শিশুটি সহ যাঁরা সীমিত ও পুরাতন সরন্ঞ্জাম দিয়ে নিজেদের ঝুঁকির মধ্য রেখে উদ্ধার কার্য চালিয়েছে। তাদের প্রতি থাকল স্বশ্রদ্ধ সালাম আর হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা। আর এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সময় অসহায় লোকজনের দিকে সহায়তার হাত নাবাড়িয়ে ছবি, ভিডিও এবং লাইভ নিয়ে যারা সদা ব্যস্ত ছিল, উদ্ধারকর্মীদের কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি করেছে, সে সব মানুষের বোধোদয় হোক। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বাড়ুক, মানবিক গুনাবলী তাদের বিবেককে দংশন করুক বার বার।
(লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, ঢাকা)