বিশেষ প্রতিনিধি:
মাত্র এক যুগ আগেও ভবঘুরের মতো ঘোরাফেরা করতেন কক্সবাজার শহরের বাসটার্মিনালের পশ্চিম লারপাড়ার লাল মোহাম্মদ প্রকাশ দালাল লাল মোহাম্মদ। এর আগে পূর্ব পুরুষের সাথে মিয়ানমার থেকে ওই এলাকায় এসে স্থায়ী হন তিনি। ছেলেরাও কাজ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু পুলিশের এক উপ-পরিদর্শকের হাত ধরে কক্সবাজার সদর মডেল থানার র্সোসের কাজ শুরুর পর থেকেই বদলে যায় তার ভাগ্য। পুলিশের সোর্সের আড়ালে শুরু করেন মাদক ব্যবসা। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়ার মতোই ইয়াবা পাচার করে রাতারাতি শুন্য থেকে কোটিপতি বনে যান এই পরিবার। শুরুতে মদ, গাঁজা ও হেরোইন বিক্রি করলেও পরে পুরোদমে শুরু করেন ইয়াবার কারবার। একাজে সম্পৃক্ত করেন ছেলে বশর, কালাম ও আবু ছৈয়দকে। তারা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে পাইকারি আকারে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেন রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত। ব্যবসা বাড়াতে পাশর্^বর্তী শশ্মানের পাশে আরেকটি বিয়ে করেন লাল মোহাম্মদ। দ্বিতীয় স্ত্রী বুলবুলির মাধ্যমে সেখানে বসানো হয় মাদকের আসর। খুচরা ও পাইকারি আকারে বিক্রি করা হয় ইয়াবা। এভাবে গত এক যুগেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান লাল মোহাম্মদ ও তার সন্তান যথাক্রমে বশির, কালাম ও আবু ছৈয়দ। খুলে বসেন একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিনেছেন জমি। পরিচিতি পান ‘ইয়াবা পরিবার’ হিসেবে। আর পুরো এলাকায় ইয়াবার কারবার ছড়িয়ে দিয়ে এলাকাটিকেও ‘ইয়াবা গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত করেন। যার কারণে সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার তা শিরোনাম হয়েছে।

এক প্রকার প্রকাশ্যে এভাবে ইয়াবা ব্যবসা করে আসলেও স্থানীয় পুলিশের সোর্স থাকার সুবাদে বড় ধরণের ঝক্কি-ঝামেলায় কখনোই পড়তে হয়নি তাদের। মাঝে মধ্যে উখিয়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন থানায় ধরা পড়লে বেশ কয়েকটি মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। ইয়াবাসহ ধরা খেয়ে জেলও খাটেন ছেলে বশির। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম আছে লাল মোহাম্মদ ও ছেলে আবুল কালামের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গঠিত যৌথ টাস্কফোর্সের সদস্যরা অভিযানও চালান তার বাড়িতে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ঠিকই নির্বিঘেœ ইয়াবার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এই ইয়াবা পরিবারের সদস্যরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, র‌্যাব, সিআইডি, দুদক, পুলিশসহ কয়েকটি সরকারি দপ্তরে এলাকাবাসীর দেয়া অভিযোগ সূত্রে উঠে এসেছে ‘ইয়াবা পরিবার’র ইয়াবা কারবারের এসব তথ্য। আর এসব তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকটি সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই এই ইয়াবা পরিবারের সদস্যরা আইনশৃংখলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ ইয়াবা, অস্ত্র ও ইয়াবা বিক্রির টাকাসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন দালাল লাল মোহাম্মদ। এসময় তার কাছ থেকে ৫ হাজার ইয়াবা, একটি দেশিয় তৈরী বন্দুক, কার্তুজ ও ইয়াবা বিক্রির নগদ এক লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। ১৪ মার্চ তাকে ইয়াবা ও অস্ত্রের দু’টি মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। মূলত: ইয়াবা নিয়ন্ত্রনে পুলিশ সুপারের কঠোর ভূমিকার কারণে তিনি ধরা পড়েন বলে জানায় সূত্রটি। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, ইয়াবা পরিবারটির মুল নিয়ন্ত্রক আবুল কালামকে নিরাপদে রাখা ও ধৃত লাল মোহাম্মদকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার নামে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। পুলিশের নামে চক্রটি মোটা অঙ্কের ওই টাকা হাতিয়ে নিলেও পুলিশ এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। পরে পুলিশের কর্মকর্তারা তা জানতে পারেন বলেও সূত্র দাবী করেছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসা করে কেউ পার পাওয়ার সুযোগ নেই। ইয়াবার বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক মাদক বিরোধী অভিযান এর আংশিক নমুনা। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযান আরও জোরদার করা হবে। নিশ্চয় এসব ইয়াবা কারবারিও রক্ষা পাবে না।’

এলাকাবাসীর অভিযোগ ও নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন আগে পূর্ব পুরুষের সাথে মিয়ানমার থেকে টেকনাফে আসেন হারু মিয়ার পুত্র লাল মোহাম্মদ। সেখান থেকে কক্সবাজার শহরের বাসটার্মিনালের পশ্চিম লারপাড়ায় এসে স্থায়ী হন তিনি। পরে অনেকদিন ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে নুনিয়াছড়ায় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে (ফিশারীঘাট) বরফ ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন কাজ করতেন। এভাবে অনেক দুঃখকষ্টে চলছিল তার জীবন। কিন্তু এক যুগ আগে হঠাৎ করেই পুলিশের এক উপ-পরিদর্শকের হাত ধরে কক্সবাজার সদর মডেল থানার র্সোসের কাজ শুরুর পর থেকেই বদলে যায় তার ভাগ্য। পুলিশের সোর্সের আড়ালে শুরু করেন মাদক ব্যবসা। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়ার মতোই ইয়াবা পাচার করে রাতারাতি শুন্য থেকে কোটিপতি বনে যান তার পুরো পরিবার। শুরুতে মদ, গাঁজা ও হেরোইন বিক্রি করলেও পরে পুরোদমে শুরু করেন ইয়াবার কারবার। একাজে সম্পৃক্ত করেন ছেলে বশর, কালাম ও আবু ছৈয়দকে। তারা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে পাইকারি আকারে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেন রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত। টেকনাফে থাকা তাদের আত্ত্বীয়-স্বজনরাও এই ব্যবসায় জড়িত। ব্যবসা বাড়াতে পাশর্^বর্তী শশ্মানের পাশে চিতা মোজাহারের মেয়ে বুলবুলিকে বিয়ে করেন লাল মোহাম্মদ। দ্বিতীয় স্ত্রী বুলবুলির মাধ্যমে সেখানে বসানো হয় মাদকের আসর। খুচরা ও পাইকারি আকারে বিক্রি করা হয় ইয়াবা। এভাবে গত এক যুগেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান লাল মোহাম্মদ ও তার সন্তান যথাক্রমে বশির, কালাম ও আবু ছৈয়দ।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় যাদের সম্পদ ও পেশা হিসেবে কিছুই ছিল না, তারা এখন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ছেলে বশর বিভিন্ন কোম্পানির এজেন্সি নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। সেই সুবাদে গাড়িতে করে পণ্য পরিবহন করে থাকে। বিভিন্ন এজেন্সির পণ্য পরিবহনের সময় কৌশলে ইয়াবা পাচার করেন বশর। গ্যাস সিলিন্ডারের গাড়িতে করে ইয়াবা পাচারের সময় তার গাড়ি ধরা পড়ে চকরিয়া থানায়। ইয়াবা পাচারের সময় তাকে হাতেনাতে আটক করে জেলে দেয়। বশর সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন সদস্যও বিভিন্ন সময়ে আটক হয়ে কারাবরণ করেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও পুরোদমে ইয়াবার কারবার চালাচ্ছে। প্রকাশ্যে লারপাড়ার নিজ বাড়িতে স্থাপিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইয়াবার কারবার চালিয়ে গেলেও অদৃশ্য কারণে ধরা পড়ছে না।

মেঝ ছেলে আবুল কালাম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। আছে পরিবহন ব্যবসাও। পরিবহন ব্যবসার আড়ালে টেকনাফ সীমান্ত থেকে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইয়াবার সেই কালো টাকা বিনিয়োগ করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে।

বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আবুল কালাম মূলত: বড় মাপের একজন তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারি। বিভিন্ন সময় তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে ইয়াবার কারবার আড়াল করার জন্য ঠিকাদারি ব্যবসাকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করছে। বড় মাপের ঠিকাদার সাজতে সে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিয়ে ম্যানেজ করে কাজ বাগিয়ে নেয়। ক্ষেত্র বিশেষে লোকসান হলেও নি¤œদর দিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়। বড় ঠিকাদার হিসেবে নিজেকে জাহির করাই তার লক্ষ্য। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, এলজিইডি, গণপূর্ত, সড়ক বিভাগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, পৌরসভাসহ বিভিন্ন দপ্তরে তার এই ঘটনাটি সকলের মুখে মুখে।

এলাকাবাসী আরও জানায়, তাকে বেশ কয়েকবার আইনশৃংখলা বাহিনী আটক করলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। শুধু তাই নয়, বাস টার্মিনাল এলাকায় কালাম এক আতঙ্কের নাম। সন্ধ্যার পর পরই সে মাদকের আসর বসায়। নিজেও মদ্যপান করে নিরীহ লোকজনকে মারধর করে। এমনকি বাবার বয়সী মুরব্বীদেরও সে লাঞ্চিত করে। কেউ প্রতিবাদ করলেই সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে মারধর করে। চাঁদাবাজি, জমি দখলেও সমান নেতৃত্ব দেয় কালামের বিশেষ সন্ত্রাসী বাহিনী। এ ধরণের অসংখ্য প্রমান আছে। এতে এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কিন্তু আইনশৃংখলা বাহিনীরই কিছু অসাধু সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার আশ্রয়ে থেকে বেশ বেপরোয়া গতিতে ইয়াবার কারবার ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে লাল মোহাম্মদের ছেলে কালাম।

আরেক ছেলে আবু ছৈয়দ। দীর্ঘদিন রাজধানী ঢাকায় থেকে কক্সবাজার থেকে পাঠানো ইয়াবার চালান সংগ্রহ করে সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাঝে সরবরাহ করতো। সেখানে অবস্থানকালে সেখান থেকে বিয়েও করেছিল। একসময় ইয়াবার একটি বড় চালান আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ায় বেকায়দায় পড়ে সে কক্সবাজার চলে আসে। ঘটনা জানতে পেরে তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দেয়। এমনকি আবু ছৈয়দ নিজেও একজন ইয়াবা সেবনকারি।

এলাকাবাসী আরও জানান, পুলিশের সোর্স হওয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই এই ইয়াবা পরিবারের সদস্যরা একপ্রকার মনোপলি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে একছত্র ইয়াবা ব্যবসার কারণে এলাকায় তারা ‘ইয়াবা পরিবার’ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন মাধ্যমে পুরো এলাকায় ইয়াবার কারবার ছড়িয়ে দেওয়ায় এলাকাটিতে এখন প্রতি বাড়িতেই কেউ না কেউ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। যার কারণে এলাকাটিও ‘ইয়াবা গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তা সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার শিরোনাম হয়েছে। ওই এলাকার ছোট-বড় সিংহভাগ ইয়াবা ব্যবসায়ীকে নিরাপদে ব্যবসার সুযোগও তৈরী করে দেন এই দালাল লাল মোহাম্মদ। তবে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গঠিত যৌথ টাস্কফোর্সের সদস্যরা তাদের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ইয়াবা নিয়ে সবাই পালিয়ে গেলেও বাড়ি থেকে ১৬টি দেশিয় অস্ত্রসহ নগদ ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৭ টাকা জব্দ করা হয়। ওই সময় লাল মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী সায়েরা খাতুনকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।