প্রথম আলো:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের অতীত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সব সময় বিরোধী ছাত্রসংগঠনই জিতেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ও সরকারের সমর্থন পাওয়া সংগঠন হেরেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ একটি পদও পায়নি।

বিএনপির সময়ে টানা তিনবার ডাকসুর নেতৃত্ব পায় জাসদ ও মাহমুদুর রহমান মান্না-সমর্থিত ছাত্রলীগ। এরশাদ আমলে দুবার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে ছাত্রদলকে পরাজিত করতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগসহ সব ছাত্রসংগঠন। সম্মিলিত চেষ্টায় ছাত্রদল তখন পরাজিত হয়। তবে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দো
লনের জোয়ারে ছাত্রদল বিজয় লাভ করে। এরপর প্রায় ২৯ বছর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি।

স্বাধীনতা-পূর্ব সময়েও ডাকসুসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ ছিল সরকারের বিপক্ষে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন বিজয়ী হয়। ডাকসুর সাবেক ভিপি (১৯৬৭-৬৮) মাহফুজা খানম এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে ডাকসু নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান গড়ে তুলেছিলেন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্ট (এনএসএফ)।

ক্ষমতায় জিয়া, পরাজিত ছাত্রদল

’৭৩ সালে নির্বাচন হলেও ভোট গণনা না হওয়ার ঘটনায় ডাকসু নির্বাচন আটকে যায় অর্ধযুগ। বিএনপির আমলে ’৭৯, ’৮০ ও ’৮২ সালে তিনটি নির্বাচন হয়। ’৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও ডাকসুতে সুবিধা করতে পারেনি প্রথমবার অংশ নেওয়া ছাত্রদল। ওই বছর ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন আলাদাভাবে অংশ নেয়। এর আগে ’৭৩-এর নির্বাচনে যৌথভাবে অংশ নিয়েছিল ওই দুটি ছাত্রসংগঠন। ছাত্রদল ছাড়াও নির্বাচনে প্রথম অংশ নেয় ইসলামী ছাত্রশিবির।

এই নির্বাচনে তিন ভাগে অংশ নেয় জাসদ ছাত্রলীগ। ডাকসুর ১৯টি পদে প্রার্থী ছিলেন ৩৫৬ জন। অন্যদিকে ১১টি হল সংসদে প্রার্থী ছিলেন প্রায় ১ হাজার। মোট ভোটার ছিলেন ১৭ হাজার ২২২ জন। এর মধ্যে ভোট দেন ৮ হাজার ৩৫১ জন।

নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন মান্না-সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না (প্রাপ্ত ভোট ৩ হাজার ২৩৭)। এই প্যানেলের আখতারুজ্জামান ২ হাজার ৭০০ ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক হন। ডাকসুর ১৯ পদের ১৫টিই পায় মান্না-সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগ। তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ পায় চারটি পদ। ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী ওবায়দুল কাদের পান প্রায় ২ হাজার ভোট। এই নির্বাচনে ভরাডুবি হয় আগের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ছাত্র ইউনিয়নের।

ছাত্র ইউনিয়নের ভরাডুবির কারণ সম্পর্কে ওই নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের জিএস প্রার্থী আবদুল মান্নান খান বলেন,স্বাধীনতাযুদ্ধের পর জাতীয়তাবাদের চেতনা যতটা প্রকট ছিল, সেটা সময়ের ব্যবধানে কমে যায়। এ ছাড়া তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মতাদর্শের সরাসরি প্রভাব পড়তে থাকে ছাত্রদের ওপর। এ পরিস্থিতির শিকার হয় ছাত্র ইউনিয়ন।

জাসদ ছাত্রলীগের সুদিন

’৭৩ সালের পর ডাকসু নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা হয় ’৮০ সালে। ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে ইত্তেফাক-এর খবরে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ভোটের আগের দিন (১৬ নভেম্বর) নির্বাচনী প্রচারের সময় স্লোগান নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রশিবির। সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের সামনের ওই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হন।

এই নির্বাচনে এসে প্রথমবারের মতো হল সংসদে আসন পায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ১১টি হল সংসদে ১৩২ আসনের মধ্যে ফজলুল হক, শহীদুল্লাহ্ ও জসীমউদ্‌দীন হলে তিনটি ভিপি এবং মুহসীন ও রোকেয়া হলে দুটি জিএসসহ হল সংসদে ২১টি আসন পায় সরকারি ছাত্রসংগঠনটি। তবে ডাকসুতে গোলাম সারোয়ার মিলন এবং এম এ কামালের নেতৃত্বে অংশ নিয়ে পদশূন্য থাকে ছাত্রদল। এই নির্বাচনে দ্বিতীয়বার ডাকসুর ভিপি-জিএস নির্বাচিত হন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। প্যানেলটি ডাকসুতে ছয়টি পদ পায়। আর ওবায়দুল কাদের-বাহালুল মজনুন চুন্নুর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ পায় ছয় সম্পাদক, সাতটি সদস্যসহ ১৩টি পদ।

টানা দুবার জাসদ ছাত্রলীগ থেকে ভিপি নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সময়ে রক্ষীবাহিনীর নির্যাতন, এরপর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাসদ ছাত্রলীগের বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। এসব আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও সমর্থন ছিল। ডাকসু নির্বাচনে এরই প্রতিফলন ঘটেছিল।

ডাকসুতে জাসদ ছাত্রলীগ, হল সংসদে ছাত্রদল

’৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর বিএনপির চেয়ারম্যান তখন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। এক বছর বিরতি দিয়ে ডাকসু নির্বাচন হয় ’৮২ সালের ২৩ জানুয়ারি। গোলাগুলি, বিস্ফোরণ আর আতঙ্কের মধ্যে শুরু হয় ওই বছরের নির্বাচন। ১১ জানুয়ারি থেকে টানা কয়েক দিন প্রচারণার পর ভোটের এক দিন আগে (২১ জানুয়ারি) রাতে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ অবজারভার-এর খবরে বলা হয়, রাত সোয়া ১০টার দিকে স্যার এ এফ রহমান হলের সামনের সড়কে মিছিল করার সময় হলের ভেতর থেকে ছোড়া দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত হন ২৪ জন। ঘটনার পর ক্যাম্পাসজুড়ে বসে পুলিশি পাহারা। এরই মধ্যে ২২ জানুয়ারি রাত ১১টায় কলাভবনের আশপাশের এলাকায় সাতটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়।

ডাকসুতে মান্না-সমর্থিত ছাত্রলীগের আখতারুজ্জামান ভিপি ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু জিএস হন। ছাত্রদলের গোলাম সারোয়ার মিলন এবং নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন প্যানেল ডাকসুতে একটিও পদ পায়নি। তবে ১১টি হল সংসদে ১৩২ পদের মধ্যে ছাত্রদল পায় ৬৫টি।

এরশাদ আমলে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে সবাই

টানা সাত বছর বিরতির পর ডাকসু নির্বাচন হয় ’৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে ছয়টি বামপন্থী ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে ছাত্রলীগ। সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রলীগ (মু-না) ও ছাত্রলীগ (সু-র)। নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকে সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রদল। তখন ডাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে জয় পায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ভিপি হন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ (ছাত্রলীগ) এবং জিএস নির্বাচিত হন মুশতাক হোসেন (ইনু-সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগ)। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শামসুজ্জামান দুদু ও আসাদুজ্জামান রিপন প্যানেল দুটি হলে পূর্ণ প্যানেলে জয় পায়।

নির্বাচনের ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত হন জাসদ ছাত্রলীগ কর্মী কফিল উদ্দিন (২৫)। অবজারভার-এর ১০ ফেব্রুয়ারির খবরে বলা হয়, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বেলা আড়াইটার দিকে উপাচার্যের বাসভবন হয়ে মধুর ক্যানটিন পর্যন্ত বিজয় মিছিল করে। মিছিলটি মধুর ক্যানটিনের সামনে গেলে শুরু হয় গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন কফিল। ওই ঘটনায় আহত হন অন্তত ৫০ জন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অভিযোগের ভিত্তিতে ইত্তেফাক-এর ১০ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন বলা হয়, ফলাফলে কারচুপির অভিযোগ এনে ক্যাম্পাসে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ছাত্রদল।

ছাত্রলীগ ও অন্যান্য বাম ধারার ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ঐক্যে ও বিজয় মিছিলে হামলার বিষয়ে তখনকার ডাকসুর জিএস ও জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আমরা নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ রাখতে চাইনি। সে জন্য ঐক্য করা হয়। কিন্তু নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জেতার পর ছাত্রদল অসুস্থ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে হামলা চালায়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তদন্ত করতে বলা হলেও পরে তারা কিছু জানায়নি।’

’৮৯ সালের নির্বাচনের সময় ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী ছিলেন খায়রুল কবির খোকন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিজয় মিছিলে হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র করে এর সঙ্গে ছাত্রদলের নাম জড়ানো হয়েছে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন সংগঠন থাকায় তাদের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। তাদের বিরোধের কারণে এমন হামলা হতে পারে। ছাত্রদল হামলা করেনি।

ছাত্রদলের বিপুল বিজয়

এর আগের নির্বাচনগুলোতে শুধু হল সংসদে আসন পেলেও নব্বইয়ের নির্বাচনে ডাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। স্বাধীনতার পর এই নির্বাচনে ভোটারসংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, ২৭ হাজার। ভোট গ্রহণ হয় ৬ জুন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার চালায় ছাত্রদল। ছাত্রদল থেকে ডাকসুর ভিপি হন আমান উল্লাহ আমান ও জিএস হন খায়রুল কবির খোকন। হল ও ডাকসু মিলিয়ে ১৮৮ আসনের মধ্যে ১৫১টিই পায় ছাত্রদল।

ছাত্রলীগের শাহে আলম ও কামরুল আহসানের নেতৃত্বাধীন প্যানেল দুটি হল সংসদে পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়। আর রোকেয়া, শামসুন্নাহার এবং এ এফ রহমান হলে সাতটি পদ পায় ছাত্র ইউনিয়ন।

নব্বইয়ের নির্বাচনে ছাত্রদলের বড় ব্যবধানে জয়ের কারণ হিসেবে খায়রুল কবির বলেন, ওই সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ছাত্রদল। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলকে ভোট দেন।

নব্বইয়ের নির্বাচনের পর আজ সোমবার হবে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একেক দেশে একেকটি গোষ্ঠী (শ্রমিক, রাজনীতিবিদ বা পেশাজীবী) অগ্রসরমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই ’৪৮ থেকে ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৯, ’৭১-সহ সামরিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ দেশের ছাত্ররা সব সময় আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিল। তাদের এই ভূমিকার সম্প্রসারণ ছিল ডাকসুসহ অন্যান্য ছাত্র সংসদ। এটাই সত্য, স্বাভাবিক ও বাস্তবতা।

[ তথ্য নেওয়া হয়েছে ইত্তেফাক, সংবাদঅবজারভার থেকে। কিছু তথ্যের সূত্র সাবেক ছাত্রনেতাদের স্মৃতিচারণা]