মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক ২০১৯ এর জন্য মনোনীত হওয়া কক্সবাজার জেলার কৃতী সন্তান শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল এ বীর শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়। নিজের জীবন তুচ্ছ করে সেই কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বীরদর্পে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে লাল সবুজের পতাকা উপহার দেয়ায় তিনি বেঁচে আছেন কক্সবাজারবাসীর হৃদয়ের মাঝে। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ এ সম্মাননা।
টগবগে যুবক, বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে মায়ের আঁচল ছেড়ে পড়তে গিয়েছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে যুগে মায়েরা সন্তানদের আগলে রাখতেন নিজ চৌহর্দী সীমানায়, সেযুগে মমতাময়ী মায়ের স্নেহের পরশ বুলানো আদর ভালবাসার স্পর্শ পরিত্যাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন যে যুবক, সে যুবকের মনের গভীরে অন্য দশজনের মত অব্যক্ত পুঞ্জিভূত স্বপ্নের সাথে মিশ্রিত ছিল হয়তো মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের হাজারো স্বপ্ন। অসাধারণ মেধাবী সে যুবক শিক্ষাজীবনের সবক্ষেত্রে রেখেছিলেন মেধার স্বাক্ষর। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রও বেছে নিয়েছিলেন। তৎকালিন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধে নিয়তি! পাকবাহিনীর নির্মম বুলেট স্তম্ভিত করে দেয় সবকিছু। সম্ভাবনাময়ী যুবক লুটিয়ে পড়েন চিরচেনা সেই প্রিয় ক্যাম্পাসে। রক্তে রঞ্জিত হল ছাত্রাবাস। রঞ্জিত রক্ত হলের সিঁড়ি বেয়ে সবুজ ঘাসের বুকে হবু স্বাধীন বাংলাদেশের কল্পিত পতাকা এঁকে ঘুমিয়ে পড়ে যুবক। মায়ের গগনবিদারী আর্তনাদও ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি যে হতভাগ্য যুবকের, তিনি আমাদের গর্বের ধন শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম। যিনি নিজের জীবন তুচ্ছ করে, কাপুরুষতা পরিহার করে হায়েনা রুপি পাকবাহিনীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বীরের বেশে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ত্রিশ লক্ষ শহীদের একজন হয়ে বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার আসনে।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতিঃ কক্সবাজার জেলাধীন উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের রুমখাঁ পালং গ্রামের মাতবর পাড়ার মরহুম তমিম গোলাল মাতব্বরের ৭ ছেলের একজন মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টার। উখিয়ার প্রথিতযশা আলেম মরহুম ছগির আহমদও তমিম গোলাল মাতব্বরের সুযোগ্য সন্তান। মরহুম তমিম গোলাল মাতব্বরের কতিপয় উত্তরসূরীদের বর্ণাঢ্য জীবনী দেখলেই অনুমান করা যায় তৎকালীন বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে এই পরিবারের বেশ যশ-খ্যাতি ছিল। সেই প্রসিদ্ধ পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টারের ঘরে ১৯৪৭ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ এ.টি.এম জাফর অালম। মাতার নাম মরহুমা আলমাছ খাতুন। মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টার ও মরহুমা আলমাছ খাতুনের দম্পতির ৮ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে শহীদ এ.টি.এম জাফর অালম ছিলেন সবার বড়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলম ও উখওয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টারের সুযোগ্য সন্তান এবং শহীদ এ.টি.এম জাফর অালমের আপন সহোদর। শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের অন্যান্য ভাইয়েরা হলেন-মোঃ নুরুল আলম, মোঃ ফরিদুল আলম, ডাঃ শামশুল আলম, মোঃ সুরত আলম ও মোঃ জুহুর আলম। একমাত্র বোন হচ্ছেন-রাবেয়া বেগম, তাঁর স্বামী কামরুল ইসলাম হচ্ছেন-ইসলামি ব্যাংকের সহকারি ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি)। শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের রত্নগর্ভা মাতা আলমাস খাতুন ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।
শিক্ষাজীবনঃ শহীদ এ.টি.এম জাফর অালম রুমখা সরকারি প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষে মহেশখালী আইল্যান্ড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ.এস.সি পাশ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উদ্দ্যেশ্য ভর্তি হয়েছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সহিত উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন শেষে তৎকালীন সিএসপি পরীক্ষায় নিজের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে নোয়াখালীর এসডিও হিসেবে নিয়োগও পেয়েছিলেন। তারআগে শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনাও করেন।
যেভাবে শহীদ হনঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চে চাকরীর নিয়োগপত্র গ্রহণ করে স্বপ্ন পূরণের সোপানে পা রাখতে না রাখতেই পরেরদিন ২৫ মার্চ স্বাধীনতার পক্ষে ডাক পড়ে শেখ মুজিবর রহমানের। আর এতেই বেপরোয়া হয়ে উঠে রাক্ষুসে পাকিস্তানি বাহিনী। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে এগোতে থাকলে জীবন রক্ষার তাগিদে হলের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী সহ শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের কাছের বন্ধুদের অনেকেই হল ছেড়ে চলে গেলেও কঠিন দেশপ্রেম তাঁর চলে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়েও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থেকে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে। ২৫ মার্চ শেষ রাতে দেশের অন্যান্য স্থানের মত পাক হানাদার বাহিনীর তান্ডবে পরিনত হয় শহীদ জাফরের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল সহ কতিপয় ছাত্রাবাস। রাইফেল হাতে দেশপ্রেমের তীব্র স্পৃহা নিয়ে পাক হানাদারদের প্রতিহত করার সমর যুদ্ধে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে রচনা করেন এক বীরত্বকাব্য।
শহীদ এ.টি.এম শহীদ জাফর আলমই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মরনোত্তর কক্সবাজার জেলায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন। শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের নামে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের নামকরণ ও রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ধেছুয়া পালং এ শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম মাল্টিপারপাস ইনষ্টিটিউট গড়ে তোলা হয়েছে। এরআগে কক্সবাজার জেলায় তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি একুশে পদক পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেন-কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালীর বাসিন্দা, বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক, জাতিসত্তার কবি নুরুল হুদা, রামু উপজেলার মেরুংলোয়া সীমা বিহারের অধ্যক্ষ সত্যপ্রিয় মহাথেরো এবং মংচিন রাখাইন। তাঁরা সকলে জীবদ্দশায় একুশে পদক পেয়েছেন।
রোববার ১০ মার্চ শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম ছাড়াও দেশের আরো ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ২০১৯ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে পদকপ্রাপ্তদের অথবা তাদের প্রতিনিধি ও স্বজনদের হাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মার্যাদাসম্পন্ন এ পদক তুলে দেবেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসিমা বেগম স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রবিবার ১০ মার্চ এতথ্য জানানো হয়েছে।
এবছর স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য যাঁরা মনোনীত হয়েছেন তাঁরা হলেন-স্বাধীনতা ও মুক্তযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে পদক পেয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (মরণোত্তর), শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম (মরণোত্তর), আ.ক.ম মোজ্জাম্মেল হক, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ডা. কাজী মিসবাহুন নাহার, মরহুম আব্দুল খালেক (মরণোত্তর), অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (মরণোত্তর), চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নুরুন্নাহার ফাতেমা বেগম, সমাজ সেবায় ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, সংষ্কৃতিতে মুর্তজা বশীর, সাহিত্যে হাসান আজিজুল হক, গবেষণা ও প্রশিক্ষণে ড. হাসিনা খাঁন ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। (পারিবারিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন:এডভোকেট শফিউল আলম শফি, শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের চাচতো ভাই।)