আতিকুর রহমান মানিকঃ

ঋতুরাজ বসন্ত শুরু হয়েছে প্রায় একমাস আগে থেকেই। এবছর তবুও যেন শীত কমছিলনা। এর উপর গত কয়েকদিন ধরেই শুরু হয়েছে মেঘলা আবহাওয়া ও অকাল বর্ষন। এতে আরো যেন জাঁকিয়ে বসেছে শীত। অথচ মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ার আনাগোনায় বাসন্তী আমেজই বিরাজ করার কথা এ সময়।

আজও বরাবরের মত রাত কিছুটা বাকী থাকতেই ঘুম ভাঙ্গল মাহমুদা বেগমের। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বাড়ির উঠানে নামেন তিনি। শেষ রাতের শীতল হাওয়ায় মেঘহীন পুর্বাকাশে শুকতারাটা ক্রমশঃ উজ্জল হয়ে উপরে উঠছে। পূর্ব দিগন্তজুড়ে এখনো গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকার একটু ফিকে হলেই প্রথম উষার আভাষ, এরপর ফজরের প্রথম আজান ও চারদিকে শত শত মাইকে আজানের কলতান, এসব প্রতিদিনের দেখা বিষয়। আঙ্গিনার একপার্শ্বে নলকুপে গিয়ে ওজু করে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়ালেন তিনি। তাহাজ্জুদ ও আরো নফল নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত। এরপর মোনাজাতে হাত তুললেন তিনি। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে প্রয়াত হওয়া মানুষটির আত্নার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে ছেলে-মেয়ে, জামাতাগন ও নাতী-নাতনীদের জন্যও দীর্ঘ মোনাজাত করলেন। মোনাজাতের পর জয়নামাজে বসে স্মৃতিকাতর হয়ে যান মাহমুদা বেগম। জীবনের এ পর্যায়ে এসে ফেলে আসা দিনগুলো ফ্ল্যাশব্যাকের মত উঁকি দেয় স্মৃতির জানালায়।

বনেদী জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়ে অঢেল প্রাচুর্যে বেড়ে উঠা তার। বাবা-চাচাদের সমন্বিত একান্নবর্তী পরিবারে চাচাত-জেঠাত-আপন ভাই বোনদের সাথে হৈ-হুল্লোড় ও বিপুল আনন্দে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। স্কুলে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতেই ক্রমাগত বিয়ের সম্বন্ধ আসতে লাগল। মুরুব্বীদের সিদ্ধান্তে একপর্যায়ে বিয়ে। বর পেশায় শিক্ষক, তাদের দুঃসম্পর্কীয় আত্নীয়। জ্ঞাতি এই আত্নীয় বংশের সাথে যাওয়া-আসা কমতে কমতে নাকি আত্নীয়তা মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই এ বিয়ের মাধ্যমে পুরনো সম্পর্ক আবার তাজা হবে, এই ছিল মাহমুদা বেগমের জমিদার দাদার অভিমত। ধুমধাম করে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ীতে এসে পরম যত্নে সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে শিক্ষক মানুষটা স্কুলে চলে গেলে এতবড় বাড়ী ভিটায় কেমন যেন শুন্যতা বোধ করতেন তিনি। সেই শুন্যতা পুরণ করতেই যেন একে একে ছয় ছেলে-মেয়ে দিয়ে বিধাতা তাদের সংসার ভরিয়ে দিলেন। ছেলে মেয়েদের শৈশব-কৈশোরে সবাই মক্তব-স্কুল-কলেজে পড়ত। প্রতিদিন ভোরে উঠে তাদের জন্য খাবার তৈরী, গোসল করানো, খাওয়ানো ও কাপড়-চোপড়ে পরিপাটি করে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পর তিনি খেতে বসতেন। এর ফাঁকেই ছেলে মেয়েদের বাবা প্রস্তুত হয়ে স্কুলে চলে যেতেন। দুপুরের পর সন্তান-সন্ততিরা ও তাদের বাবা ফিরে এলে আবারো তাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবেই তার খাওয়া। সন্ধ্যার পর আবার সবাইকে পড়তে বসানো ও রাত হলে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমপাড়ানো। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াসহ যাবতীয় ব্যাপারে সার্বিক তদারকীতে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এভাবেই কাটত তার ব্যস্ত সময়।

সংসার সামলানোর এ শিক্ষাটা হাতে কলমে পেয়েছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে। স্বামী মানুষটা শিক্ষকতা, নিজস্ব ব্যবসা ও সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে রাতদিন ব্যস্ত থাকতেন। কোনরকমে বাজার সদাইটুকু করে দিয়েই তিনি বাইরের কাজে মন দিতেন। ছেলে-মেয়ে ও সংসার একাই সামলাতেন মাহমুদা বেগম। মায়ের কোমল স্নেহ, কঠোর শাসন ও নিবিড় তত্বাবধানে ছেলে-মেয়েদের কারো একটুও এদিক-সেদিক হওয়ার জো ছিলনা। এভাবে চলতে চলতে ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে সকলে উচ্চশিক্ষিত হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী চাকরী, সাংবাদিকতা ও ব্যবসায় আজ তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আর মেয়েজামাইরা আর্মি অফিসার, অধ্যাপক, ব্যাংকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা।

বাংলার অন্যসব মায়েদের মত সারাজীবন ছেলে মেয়েদের মানুষ করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সরকারী চাকরী থেকে এরি মধ্যে অবসর নিয়েছেন শিক্ষক স্বামী। অবসরপ্রাপ্ত মানুষটার পরিচর্যা ও টুকটাক সাংসারিক কাজে ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। প্রতিবছর ঈদের পরে ও বিভিন্ন উৎসব-অনুষঙ্গে মেয়ে-জামাই-নাতী-নাতনীরা বেড়াতে এলে কয়েকদিন বাড়ীটা মুখরিত থাকে। দুষ্টু- মিষ্টি নাতী-নাতনীরা নানু বলতে অজ্ঞান। জামাতাগন আম্মা-আব্বা বলতে অজ্ঞান। বেড়ানো শেষে চলে গেলেও মেয়ে ও জামাতাগন সবসময়ই খবরাখবর নেয়।

অবসরপ্রাপ্ত মানুষটার শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছিলনা কিছুদিন ধরে। মাহমুদা বেগমের নিজের শরীরেও বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন রোগব্যধি। গত বছর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বাবা- মা দুজনকেই চিকিৎসা করিয়েছে ছেলেমেয়েরা। এরমধ্যে হঠাৎ বড়ধরনের ছন্দপতন ঘটল এতদিনের ছকবাঁধা জীবনে। ষ্ট্রোকপরবর্তী মাত্র একদিনের অসুস্হতায় স্বামী মানুষটা চলে গেলেন পরপারে। ছাত্র-সহকর্মী-আত্নীয়-স্বজন৷ বন্ধু-বান্ধব ও এলাকাবাসী সমবেত হয়েছিল বিশাল জানাজায়।

এরপর থেকেই কেমন যেন শুন্যতায় কেটে যাচ্ছে দিনগুলি। সব সময়ই ছেলেমেয়ে ও জামাতারা খবর নেয়। সামান্য একটু অসুখ হলেই জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, যেতে না চাইলে ডাক্তার বাড়ীতে আনে। তার পছন্দের খাবার ও ফলমুলে বোঝাই হয়ে আছে বাসার ফ্রীজটা। তিনি খেতে পারেননা, মানা করলেও শুনেনা তারা। বাজার থেকে একগাদা নাস্তা নিয়ে আসে, পাঠিয়ে দেয়। তাদের বাবা থাকতেও এরকম করত ছেলেমেয়েরা। তাদের বেড়ে উঠা, শিক্ষাজীবন ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে বাবার পাশাপাশি মায়ের অবদান কোন অংশেই যেন কম নয়।

আবহমান বাংলার প্রতিটি পরিবারের চিত্রই এরকম। পরিবারের কর্তা পুরুষরা চাকরী, ব্যবসা ও বৈষয়িক দিকগুলো দেখাশুনা করে উপার্জনের পথটা সুগম রাখেন। আর নারীরা রান্না-বান্নার পাশাপাশি সন্তান-সন্ততিদের সাজ-পোশাক, যত্ন, লেখাপড়া ও লালন-পালনসহ যাবতীয় তদারকিতে রাতদিন ব্যস্ত থেকে তাদের আগলে রাখেন। এসব কাজ কিন্তু পুরুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। অন্ততঃপক্ষে মাধ্যমিক শ্রেণী ডিঙ্গানো পর্যন্ত মায়ের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে থাকে ছেলেমেয়রা। প্রত্যেক সন্তান ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ-রুচির ও মানসিকতার, কিন্তু মা সবার কাছে সার্বজনীন। সন্তানদের চাহিদা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তার কাছে মুখস্হ। তাইতো মায়েরা দক্ষ হাতে সামাল দিয়ে আসছেন পরিবারগুলো।

এছাড়াও বাড়ীতে কুটুম্ব-মেহমান আসবে, আয়োজন করতে হবে, আবার আত্নীয় বাড়ীতে যেতে হবে, যাওয়ার সময় কি কি নিতে হবে, (আত্নীয়) রোগী দেখার সময় খাদ্যদ্রব্য কি নিতে হবে এসব বাজেট প্রনয়ন করেন নারীরা। কারন এ ব্যাপারে কর্তারা অজ্ঞ বললেই চলে। তাই অন্তঃপুরবাসিনীদের পরামর্শ মোতাবেক কর্তা পুরুষরা বাজার সদাই করে দিয়েই দায় সারেন, বাকি সব ম্যানেজমেন্ট নারীরাই করেন। বাড়ীর শষ্য ব্যবস্হাপনা, গমহপালিত পশু-পাখি ব্যবস্হাপনা, খাদ্য ব্যবস্হাপনা, অতিথি আপ্যায়ন ব্যবস্হাপনা ও বয়স্ক মুরুব্বীদের সেবা, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্হাপনাসহ পারিবারিক অনেক কাজেই মা অর্থাৎ নারী একজন দক্ষ (অবৈতনিক) ম্যানেজারের বহুমুখী ভূমিকা পালন করেন সারাজীবন ধরে। পরিবার পরিচালনায় এভাবে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহন না থাকলে পুরুষদের পক্ষে একা সব সামলানো সম্ভব হতনা।

বাংলার বধু, সত্য-মিথ্যা, স্বামী-স্ত্রী, বৌ মা, সোনার সংসার, পিতা-মাতা-সন্তান ও এই ঘর এই সংসার সহ সুপারহিট জীবনমুখী বাংলা সিনেমাগুলোতে
আবহমান বাংলার নারীদের হাজারো বছরের এ চিত্রই উঠে এসেছে। আন্তরালে থেকে সারাজীবন এভাবেই নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে এক-একটি পরিবারকে চালিয়ে নিয়েছেন বাংলার নারীরা।
বহুমুখী দায়িত্বে এখানে নারীদের অংশগ্রহন কেবলমাত্র একদিন নয়, বরং সপ্তাহ-মাস-বছর ও যুগ যুগ ধরে।

তাই কেবলমাত্র বছরের নির্দিষ্ট দিনকে “তথাকথিত নারী দিবস” মানতে নারাজ মাহমুদা বেগমের উচ্চশিক্ষিত সন্তান-সন্ততিরা। তাদের ভাষায়, বছরের প্রতিদিনই নারী দিবস। নারীদের শ্রদ্ধা করতে হবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষন। পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্হায় ছেলে মেয়েদের সাথে শৈশবে বাবা মায়ের যোগসুত্র তেমন একটা থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় পারিবারিক বন্ধন শক্ত। বাবা মায়ের স্নেহ-শাসনে বড় হয় সন্তান-সন্ততিরা। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা অর্থাৎ মায়েরাও এখানে (পর্দার আড়ালে থেকে) পরিবার পরিচালনায় সমান ভূমিকা রাখেন। তাই সারাবছর, প্রতিদিন, প্রতিক্ষনই এখানে নারী দিবস। আবহমান বাংলার পরিবার ব্যবস্হায় এ ধারা চলে আসছে হাজার বছর ধরে। তাই বছরের কেবলমাত্র একটি দিন তথাকথিত নারী দিবস পালন করা এখানে অযৌক্তিক ও নারীদের অবমানা করারই শামিল।

হাল আমলে পাশ্চাত্যের আমদানী করা ভিনদেশী বিজাতীয় সংস্কৃতির তথাকথিত নারী দিবসের অসারতা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে শুনা এসব কথা ভাবতে ভাবতে ফজরের আজান হতে শুনলেন মাহমুদা বেগম। শৈশব-কৈশোরে ভিতরে বাইরে সবসময় বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে মাহমুদা বেগমের মত নারীরা নিঃস্বার্থ শ্রমে এগিয়ে নিয়েছেন নিজ নিজ পরিবারকে। স্কুল জীবনে পড়া কাজী নজরুল ইসলামের “নারী” কবিতাটি মনে পড়ে তাঁর।

“সাম্যের গান গাই –
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে – শয়তান যে – নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্ণী, গানের লক্ষ্ণী, শস্য-লক্ষ্ণী নারী,
সুষমা-লক্ষ্ণী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সে মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে’
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালি ধানের শীষে।
স্বর্ণ-রৌপ্যভার
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,
রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।
পুরুষ হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না ক’ অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব।
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা।
লব-কুশে বনে তাজিয়াছে রাম, পালন করেছে সীতা।
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভূতরূপে পুরুষ পুরুষ করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে করে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ।
তিনি নর-অবতার –
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি’ কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর –
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
যুগের ধর্ম এই-
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।
শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোম্টা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!
ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল ‘প্নুটো’ যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি’
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!”

নারী দিবস হোক প্রতিদিন।

লেখক: সংবাদকর্মী।