প্রেস বিজ্ঞপ্তি:

“সমুদ্রকে রাখিব  প্লাস্টিক মুক্ত” এই নীতিকে  বুকে ধারণ করে গত ২৭  শে ফ্রেব্রুয়ারী সেন্টমার্টিন দ্বীপে “বীচ ক্লিনাপ প্রোগ্রাম” বা “সৈকত পরিষ্কার কর্মসূচী” উদযাপন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফী (সমুদ্রবিজ্ঞান) বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ওশানোগ্রাফী বিভাগের ৫ টি ব্যাচের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী এই কর্মসূচীতে অংশ নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফী বিভাগের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন মুন্না, সহকারী অধ্যাপক মো: এনামুল হক ও সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার এর তত্ত্বাবধানে এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়।

 এসময় বেশ কয়েকটি ডাস্টবিনে বিভিন্ন প্রকার প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। বীচের অসংখ্য প্লাস্টিক বোতল,পলিথিন, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট,প্লাস্টিক স্ট্র, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেট ইত্যাদি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপকে পরিণত করেছে ময়লার স্তুপে। এইভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে। সহকারী অধ্যাপক মো: এনামুল হক বলেন, “বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণ ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে যা জলজ বাস্তুসংস্থানের প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে প্রাণিকুল হবে বিলুপ্ত আর ধ্বংস হবে মানবকুল।”

সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দীন মুন্না বলেন- ” বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে পরিবেশ বান্ধব পর্যটক ও পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই আমাদের এই সম্মিলিত প্রয়াস।”

 সহকারী অধ্যাপক সাইদুল ইসলাম সরকার যোগ করেন-  “সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে এই ধরণের কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য সামুদ্রিক জীবকূলের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। প্রতিবছর প্রায় ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের ফলে মারা যায়। পলিথিন ,প্লাস্টিকের ফলে সমুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে বিরুপ প্রভাব পড়ে। প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে পতিত হয়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে ৷ এই প্লাস্টিক পদার্থের পরিমাণ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে ৷ প্লাস্টিক থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন ইত্যাদি পরিস্রুত হয় ৷ এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমুদ্রের পানিতে ৫ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক ভেসে থাকে৷

প্লাস্টিক দূষণ প্রাণীকুলের খাদ্যচক্রের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে ৷ এটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে ৷ বেশকিছু সামুদ্রিক প্রজাতি, যেমন সামুদ্রিক কচ্ছপের পাকস্থলীতে বিজ্ঞানিরা প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য পেয়েছেন ৷ এসব প্লাস্টিক বর্জ্য তাদের পরিপাকতন্ত্রকে নষ্ট করে দেয় ৷ সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু ঘটছে প্লাস্টিক দূষণের কারণে৷ সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিশ, সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবনধারণ করে৷ জেলিফিসের আকার ও আকৃতি প্লাস্টিক ব্যাগের মত হওয়ায় কচ্ছপ ভুল করে প্লাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে৷ এতে তাদের খাদ্য নালিকা বন্ধ হয়ে যায়, প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় এবং খাদ্য গ্রহন করতে অক্ষম হওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায়৷ কচ্ছপের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি৷ সামুদ্রিক তিমির পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে।

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব শুধুমাত্র সামুদ্রিক মাছের উপর নয় সামুদ্রিক পাখির উপরও রয়েছে। বেশিরভাগ সামুদ্রিক পাখির পেটে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া যায়৷ সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্যে তুলনা না করতে পারায় পাখিরা বিভিন্ন প্লাস্টিক দ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে৷ ২০০৪ সালের এক গবেষণায় মাধ্যমে গবেষকরা জানান “সামুদ্রিক গিল” এর পেটে ৩০ খন্ডের সম পরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যায় যা বর্তমানে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। প্লাস্টিক পদার্থ থেকে সাধারণত বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়৷ এই বিষাক্ত রাসায়নিক দেহের বিভিন্ন টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে৷ পাখিরা যখন প্লাস্টিক পদার্থ গ্রহন করে তখন তাদের পেটেও বিষাক্ত রাসায়নিক পলিক্লোরিনেটেড বায়োফেনল নির্গত হয়৷ এর জন্য তাদের দেহের টিস্যু ধ্বংস হয়, তাদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়৷ ধীরে ধীরে পাখির মৃত্যু হয়।এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায় যে,উত্তর ক্যরোলাইনে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লাইসন অ্যালবাট্রস বাস করে যাদের পাকস্থলিতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পদার্থ পাওয়া যায় এবং এর ফলে তাদের মৃত্যু ঘটে।

প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।খাদ্যজালের মাধ্যমে এসব প্লাস্টিক মানুষের দেহে প্রবেশ করে জটিল সব রোগ ব্যাধি সৃষ্টি করে। সাধারনত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসকল রঞ্জক কারসিনোজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

প্লাস্টিক দূষণ যদি এইভাবে বাড়তে থাকে তবে বিলুপ্ত হবে প্রাণীকূল। প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়তে থাকলে প্রাণীকূল ক্রমশ ধ্বংসের দারপ্রান্তে পৌঁছাবে।তাই পর্যটকরা যাতে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ভবিষ্যতে প্লাস্টিক দূষণ না করেন সেজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এই আত্মপ্রয়াস।

সকল পর্যটক সমুদ্রকে প্লাস্টিক মুক্ত রাখবে এবং পরিবেশ বান্ধব পর্যটন গড়তে সহায়তা করবে এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।