শাহেদ মিজান, সিবিএন:
কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র, তরল গ্যাসের ডিপো স্থাপন ও বিশেষ বাহিনীর স্থায়ী বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণের জন্য মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, কালামারছড়া ও হোয়ানকের চাষযোগ্য অন্তত ৯০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যে অধিগ্রহণের আওতায় পড়া ধলঘাটা ও মাতারবাড়ির সব জমি হুকুম দখল করেছে সরকার। কালামারছড়া ও হোয়ানকের জমিগুলো হুকুম দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর ফলে চলতি মৌসুমই সবখানের জমির চাষ শেষ হচ্ছে!

জানা গেছে, অধিগ্রহণের ফলে মাতারবাড়ি ও ধলঘাটার অন্তত ৩০ হাজার মানুষ তিন বছর আগেই কর্মহীন গেছে এবং আর মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে কর্মসংস্থান হারাবে কালামারছড়া ও হোয়ানকের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। সব মিলে অধিগ্রহণের ফলে চার ইউনিয়নের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ নিশ্চিত কর্ম হারাচ্ছে! ইতিমধ্যে কর্ম হারিয়ে বেকার রয়েছেন মাতারবাড়ি ও ধলঘাটার মানুষগুলো। হোয়ানক ও কালারমারছড়ার মানুষেরা এখন কর্ম হারানোর চরম আতঙ্কে ভুগছেন। তাই ভুক্তভোগী এসব মানুষেরা অধিগ্রহণের আগে পুনর্বাসন করার দাবি জানাচ্ছেন। একই সাথে জমির ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, দুষ্টুচক্রের উৎপাত রোধ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করণেরও দাবি করেছেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ি-ধলঘাটায় প্রথম কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১২’শ এবং মাতারবাড়িতে দ্বিতীয় কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৪ একর জমি ইতিমধ্যেই অধিগ্রহণ করে হুকুম দখলে নিয়ে সরকার। অন্যদিকে পাঁচ হাজার একরের বৃহৎ কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কালারমারছড়া ও হোয়ানকের পশি^মে লবণ ও চিংড়ি চাষের পাঁচ হাজার একর জমি বর্তমানে অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সাত ধারা দিয়ে জমি টাকা ছাড়া হচ্ছে। তার পাশপাশি কালারমারছড়া ও হোয়ানকের পূর্বে অবস্থিত পাহাড়ি জমিগুলোও অধিগ্রহণ করে হুমুক দখলে নেয়া হচ্ছে। তবে খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ায় পাহাড়ি জমিতে কোনো ধরণের ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না জমির মালিকেরা। ইতিমধ্যে পাহাড়ি জমিগুলো দখলে নিয়ে সেখানে স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে জোরেসোরে। এই জন্য কেটে বিলীন করা হচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়ও ।

স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহেশখালীর মানুষের আয়ের প্রধান দুটি উৎস হচ্ছে লবণ চাষ ও পান চাষ। লবণ ও পানচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন সেখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে সরাসরি চাষী, বর্গচাষী এবং শ্রমিক। লবণ ও পান চাষ করেই চলে ৯০ শতাংশ পরিবার। মহেশখালীর লবণ ও পান পুরো দেশের একটি বৃহৎ চাহিদা মিটিয়েই আয় করা হয় এসব অর্থ। কিন্তু সব লবণ জমি ও পাহাড়ি পানচাষের জমি অধিগ্রহণ করে নেয়ায় পুরোপুরিই কর্ম হারাচ্ছে হোয়ানক ও কালারমারছড়া মানুষ।

কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক শরীফ জানান, হোয়ানক ও কালারমারছড়ার মানুষ পুরোপুরিই লবণ ও পানচাষের উপর নির্ভর। এই দুটি আয়েই চলে সবার জীবন। কিন্তু এই দুই ইউনিয়নের সব লবণ জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়ে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়ের বিশাল অংশজুড়ে সুদীর্ঘকাল ধরে হয়ে আসা পানচাষও আর হবে না। এতে জন্ম থেকে এই কর্মের সাথে জড়িত এখানকার অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ নিশ্চিত কর্ম হারাচ্ছে। কর্ম হারাতে যাওয়া এসব মানুষ পুরোপুরিই বেকার হয়ে পড়বে।

তিনি জানান, অধিগ্রহণের কারণে মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, কালামারছড়া ও হোয়ানকের সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে শুধুমাত্র একটি অংশ। এই সংখ্যা বেশি হলে ১০ শতাংশ হবে। বাকি ৯০ শতাংশ মানুষ কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না।

অন্যদিকে খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ায় অধিগ্রহণ করা পাহাড়ের জমিগুলোর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না। অথচ এই জমিগুলো মালিকানা বিক্রি হয় একর প্রতি পাঁচ লাখেরও উপরে। এখন অধিগ্রহণ হয়ে যাওয়ায় মালিকেরা কোনো টাকা পাচ্ছে না। পাশাপাশি পাহাড়ের পান চাষীদের জন্যও কোনো পুনর্বাসন অর্থ বরাদ্দ নেই আপাতত।

অধিগ্রহণ আইন মতে, অধিগ্রহণে পুনর্বাসনের একটি ক্ষতিপূরণের অর্থ থাকলেও তা এখন ছাড়া হচ্ছে না এবং তা কখন ছাড়া হবে তাও নিশ্চিত করতে পারেনি প্রশাসন। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও মাতারবাড়ির কেউ এখনো পুনর্বাসন ক্ষতিপূরণ পায়নি। কবে পারে তাও নিশ্চিত নয়। অদূর সময়ে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না।

ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন বলছেন, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কোনো রকম বিশেষ দাবি-দাওয়া ছাড়াই সরকারের আদেশ ও নিয়ম মতে তারা জমিগুলো দিয়ে দিচ্ছেন। এতে জমির মালিকের চেয়ে শ্রমিক, চাষী ও বর্গাচাষীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের আওতায় আনা হলেও শ্রমিক, চাষী ও বর্গাচাষীদের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে না। পুনর্বাসন করা না হলে জীবিকার জন্যই মহেশখালীর মানুষকে পরিবার নিয়ে জন্মভূমি ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হতে হবে। এমন অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে না দিয়ে অধিগ্রহণের আগেই তাদেরকে পুনর্বাসন করার দাবি জানাচ্ছেন তারা।

জানা গেছে, পুনর্বাসনের দাবিতে মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, কালামারছড়া ও হোয়ানকের সব মানুষ এখন নানাভাবে সরব হয়ে উঠেনে। তারা পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্নভাবে সরকার ও প্রশাসনের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। পুনর্বাসন, জমির ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, দুষ্টুচক্রের উৎপাত রোধ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করণে ‘আগে পুনর্বাসন, পরে অধিগ্রহণ’ শ্লোগানে ‘মহেশখালী জাগ্রত ছাত্রসমাজ’ নামে একটি সংগঠন নানা কার্যক্রম শুরু করেছেন। তারা জনসচেনতা বৃদ্ধি এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে একটি বিশাল মানববন্ধন করেছেন। বর্তমানে এলাকাভিত্তিক গণসংযোগ করছেন। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি তারা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের চত্বরে একটি মানববন্ধন করবেন বলে জানা গেছে।

‘মহেশখালী জাগ্রত ছাত্রসমাজ’র প্রধান সমন্বয়ক ফজলে আজিজ মোঃ ছিগবাতুল্লাহ বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই মহেশখালীর মানুষ নির্দি¦ধায় সব জমি দিয়ে দিচ্ছে। সেখানে করা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতো দেশের ও মানুষের উন্নয়নের জন্যই হচ্ছে। কিন্তু মহেশখালীর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষতো এই উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে না। জমি ও কর্ম হারিয়ে জীবিকার জন্য তাদেরকে জন্মভূমি ছাড়তে হচ্ছে। যদি হয় তাহলে এই উন্নয়নের সার্থকতা থাকবে না। তাই আগে ক্ষতিগ্রস্তদের উন্নয়নই করতে হবে। তাদেরকে পুনর্বাসন করেই উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করাই আমাদের দাবি।’

এ ব্যাাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহেশখালীকে অনেক উন্নয়ন দিয়েছেন। তিনি মহেশখালীকে সিঙ্গাপুর করার জন্য কাজ করছেন। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্ত সবার ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। সব মানুষ যেন ক্ষতিপূরণের সুবিধা পায় তার জন্য অত্যন্ত কঠোর তিনি। পুনর্বাসনের জন্য অর্থ বরাদ্দ আছে, তবে আপাতত ছাড়া হচ্ছে না। অতি অল্প সময়ে ছাড়া খুব প্রয়োজন। না হলে মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে। তার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করবো।’