সংবাদ বিজ্ঞপ্তি:
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেল লাইন সম্প্রসারণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমি পূরণে নতুন বন সৃষ্টির দাবি জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭েফেব্রুয়ারী) দুপুরে কক্সবাজার জলবায়ু ফোরামের প্রেস কনফারেন্স থেকে এ দাবি জানিয়েছে বক্তারা।

কক্সবাজার প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত প্রেসকনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন কক্সবাজার জেলা জলবায়ু ফোরামের সভাপতি মুহম্মদ নূরুল ইসলাম।

জেলা জলবায়ু ফোরাম কোস্ট ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত ‘জলবায়ু অর্থায়নের স্বচ্ছতা অর্জন কৌশল’ প্রকল্পের আওতায় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় কক্সবাজার অঞ্চলে বনাঞ্চল হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা জলবায়ু ফোরামের দাবিসমূহ সংবাদ কর্মীদের সামনে তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জেলা জলবায়ু ফোরামের সভাপতি মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন মকবুল আহমেদ, সহকারী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট, কক্সবাজার উপজেলা জলবায়ু ফোরামের সেক্রেটারী অধ্যাপক রোমেনা আকতার, সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুছ, সদস্য রুহুল কাদের বাবুল, সদস্য মিজানুর রহমান বাহাদুর, সদস্য ইলিয়াছ মিয়া প্রমূখ।

মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর বরাত দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) উষ্ণায়নজাত বিপদের যে আভাস দিয়েছে, যে হারে বাড়ছে বা ইতিমধ্যেই বেড়ে গিয়েছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা, তাতে সমূহ বিপদ আমাদের অপেক্ষায়। সামগ্রিক ভাবে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা গত দেড়শো বছরে তুলনায় ১ ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে। অবিলম্বে পৃথিবীকে কার্বন নিরপেক্ষ করে তোলার দিকে অগ্রসর হতে না পারলে আগামী এক দশক বা তার একটু বেশি সময়ের মধ্যেই আরও অনেকটা বেড়ে যাবে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা, রিপোর্ট তেমনই বলছে।

কার্বনডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হয়ে পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়লে তা পৃথিবীর তাপকে ধরে রাখে যার ফলে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পৃথিবীর নিম্নাংশ প্লাবিত করে দিতে পারে। একেই বলা হচ্ছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া।

আইপিসিসি-র বরাত দিয়ে তিনি বলেন, তাপমাত্রা এ ভাবে বাড়তে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কি হতে পারে? বরফ গলে গিয়ে সমুদ্র্রে জলস্তর বেশ খানিকটা বেড়ে যেতে পারে এবং তাতে অনেক দ্বীপরাষ্ট্র ডুবে যেতে পারে। উপকূলীয় এবং উপকূলের নিকটবর্তী এলাকাগুলোও জলমগ্ন হয়ে পড়তে পারে, বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিটেমাটিহীন-উদ্বাস্তু হয়ে পড়তে পারেন, পৃথিবীর নানা অংশে তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে, একের পর এক ঝড় আঘাত হানতে পারে।

যে হারে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন ঘটছে রোজ, তাতে এই মুহূর্তে রাশ টানা না গেলে ২০৩০ সাল নাগাদই পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদ। আইপিসিসি এমন জানিয়েছে।

নিস্তার পাওয়ার পথ কি? একমাত্র পথ কার্বন নির্গমন কমানো। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে বিপদের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছতে দিতে না চাইলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হতে হবে এ গ্রহকে। অর্থাৎ রোজ যে পরিমাণ কার্বনের নির্গমন ঘটবে, সেই পরিমাণ কার্বনই রোজ বাতাস থেকে শুষে নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। তবেই পৃথিবী কার্বন নিরপেক্ষ হবে।

কিভাবে সম্ভব এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর? পৃথিবীর জিডিপির আড়াই শতাংশ অর্থ প্রতি বছর বিনিয়োগ করতে হবে শক্তিক্ষেত্রে। অথবা গাছ লাগাতে হবে বিপুল সংখ্যায়, সবুজ রঙে মুড়ে ফেলতে হবে পৃথিবীকে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুহম্মদ নূরুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও বিপদাপন্ন জনসাধারণের সুরক্ষা এবং একইসঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে চূড়ান্ত জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম এ ধরনের উদ্যোগ নেয় যা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারণা, প্রস্তুতি ও অবস্থানের বৈশ্বিক স্বীকৃতি এনে দেয়।

কক্সবাজার অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান হারে বন হ্রাসের প্রসঙ্গে ফোরাম সভাপতি মুহম্মদ নূরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বোচ্চ বিপদাপন্ন দেশগুলোর অন্যতম হিশেবে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং দেশের মধ্যে কক্সবাজার জেলা উপকূলীয় জেলা হিসেবে অধিক বিপদের মুখোমুখি। এই অবস্থায় কক্সবাজার জেলায় রাহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্প স্থাপনে ও কক্সবাজারের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের ফলে ব্যাপক বনভূমি ধ্বংস হয়েছে এবং হতে চলেছে। যেখানে রাষ্ট্রের পরিকল্পনা রয়েছে বন রক্ষার ও আরো পুনর্বানয়নের; সেক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে বনের হ্রাস পেতে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ; সে অর্থে সরকারের উদ্যোগে বন রক্ষা ও পুনর্বনায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ অতি জরুরি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগেও বৃক্ষরোপন ও বনসৃজনের গুরুতকোনো অংশে কম নয়।

তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চুনতি বনবিভাগ অফিসের কাছে থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে চুনতি অভয়ারণ্যের বনাঞ্চলের উপরে দিয়ে রেল লাইন স্থাপনের ফলে বনের ক্ষতির পরিমান হতে পারে আনুমানিক ১১৮ একর এবং স্থানীয় জনগণের ধারণা অনুযায়ী উক্ত এলাকা থেকে ৬০ থেকে ৮০টি পরিবার বাস্তুচ্যুত হবে।

কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থেকে রামু উপজেলার ৮টি মৌজার প্রায় ৮০ একর বনভূমি রেল লাইন স্থাপনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং রামু থেকে কক্সবাজার ৫ একর সরকারী বন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফাঁসিয়াখালী, রিংবং প্রভৃতি বনাঞ্চলে অনেক অবৈধ বসবাসকারী পরিবার রয়েছে। রেল লাইন সম্প্রসারণের ফলে তাদের মধ্যে ১৫০ হতে ২০০ পরিবার উচ্ছেদ হবে। এর মধ্যে অনেক ব্যক্তিগত বৃক্ষ ও বন ক্ষতিগ্রস্ত হবে যা এই হিসেবের মধ্যে ধরা হয় নি।

ফোরাম সভাপতি জলবায়ু ফোরামের পক্ষ থেকে নাগরিক সমাজের দাবি নিম্নলিখিত দাবিসমূহ তুলে ধরেন।

কক্সবাজার জেলার অনেক বনাঞ্চল ডিসি (ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার) খতিয়ানভুক্ত বা ১নং খতিয়ানভুক্ত। উক্ত বনাঞ্চল অনেক ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি নামে বন্দোবস্তি নিয়ে নেয় এবং বনের ক্ষতি করে বসতি স্থাপন ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করে থাকে। এতে বনের প্রভূত ক্ষতি হয়। তাই উক্ত ডিসি খতিয়ানভুক্ত (১নং খতিয়ান) বনাঞ্চল বন বিভাগের খতিয়ানে স্থানান্তর করা আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ মনে করেন।

জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, ইকো পার্ক, সাফারী পার্ক প্রভৃতি এলাকায় অবৈধভাবে বসবাসকারীদেরকে অন্যত্র কোনো সুনির্দিষ্ট নির্বাচিত এলাকায় পুনর্বাসন করা হোক।

ফাঁসিয়াখালী, রিংবং প্রভৃতি বনাঞ্চলে অনেক অবৈধ বসবাসকারী পরিবার রয়েছে। রেল লাইন সম্প্রসারণের ফলে তাদের মধ্যে ১৫০/২০০ পরিবার উচ্ছেদ হবে। তাদেরকে সুনির্দিষ্ট স্থানে পুনর্বাসন না করলে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারসমূহ ক্ষতিপূরণ পেয়ে আবার অবৈধভাবে বনাঞ্চল দখল করবে এবং বনের ক্ষতি করবে। তাই তাদেরকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্বাচিত স্থানে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারসমূহকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে পুনরায় বনাঞ্চল ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে।

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেল লাইন সম্প্রসারণের দাবি এই অঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের একটি অন্যতম দাবি। সরকারের উদ্যোগে তা পূরণ হতে চলেছে। এতে পর্যটন শহর কক্সবাজারের গুরুত্ব অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সাথে দেশের বিপুল পরিমান বনভূমির সম্পদের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে দেখলে এই ক্ষতি অপূরণীয়। তাই আমরা সরকারের নিকট দাবি তুলছি- এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত বনের অন্তত পাঁচগুণ নতুন বন সৃজন করা আবশ্যক। সরকার যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখছে এবং টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলার নিমিত্ত উক্ত প্রস্তাবিত বন সৃজন অতি প্রয়োজন।

শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন সাংবাদিক জাহেদ সরওয়ার সোহেল, একরামুল হক টিপু, এইচ এম এরশাদ, মোয়াজ্জেম হোসেন শাকিল, সরওয়ার আজম মানিক, স.ম. ইকবাল বাহার চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম সোহেল। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ‘জলবায়ু অর্থায়নের স্বচ্ছতা অর্জন কৌশল’ প্রকল্পের জেলা টিম লিডার মকবুল আহমেদ ও কক্সবাজার জলবায়ু ফোরাম সভাপতি মুহম্মদ নূরুল ইসলাম।