রঞ্জন বসু, বাংলাট্রিবিউন, দিল্লি:

বাংলাদেশ-ভারতবাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে খুবই ঘনিষ্ঠ, এটা যদিও কোনও নতুন কথা নয়— তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত মাসে (জানুয়ারিতে) আওয়ামী লীগ সরকার টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর ভারত বিশেষ আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখছে। আর তার পেছনে অনেকগুলো বিশেষ কারণও আছে।

বাংলাদেশের নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল এরইমধ্যে আভাস দিয়েছেন, তার দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার এবছর ৭.৮ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে জিডিপি সাড়ে ৮ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

কিন্তু শুধু জিডিপি’র হার বাড়লেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে না বলেই ভারতের ধারণা। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের অর্থনীতিতে এমন অনেকগুলো বিষয় আছে, যার সঙ্গে ভারতের স্বার্থও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আর সেগুলোতে শেখ হাসিনার নতুন সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় বা কোন পথে চলে, সেদিকে দিল্লি সাগ্রহে তাকিয়ে আছে। এমনই কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো।

ক. অবাধ বাণিজ্য চুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট কী হবে?

ভারত ভীষণভাবেই চাইছে, বাংলাদেশের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে একটি অবাধ বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করুক, যার আওতায় পণ্য, পরিসেবা বা বিনিয়োগের মতো নানা জিনিস থাকবে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী সুরেশ প্রভু যখন ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন, তিনিও এই ধরনের একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির জন্য সওয়াল করে এসেছেন।

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার কথায়, ‘বাংলাদেশ যখনই স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের পর্যায় থেকে উন্নীত হচ্ছে, তখনই কিন্তু ভারতের বাজারে তাদের পণ্য আর কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না।’

‘ফলে এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যে বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) আছে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশকে অবাধে ঢুকতে হলে সেটা আর যথেষ্ট নয়। এই কারণেই আমরা দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে একটি আলাদা এফটিএ চাইছি।’

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৩০ কোটি ডলার, যা বিগত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৮০ কোটি ডলার বেশি। কিন্তু একটি অবাধ বাণিজ্য চুক্তির অভাবে এই বৃদ্ধি থমকে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও আছে অনেক অর্থনীতিবিদের।

প্রসঙ্গত, আলাদা করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের আলোচনা চলছে শ্রীলঙ্কা, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো নানা দেশের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কা ও চীনের সঙ্গে সেই আলোচনায় বেশ অগ্রগতি হলেও ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের প্রস্তাবিত এফটিএ কিন্তু এখনও অগ্রগতি হয়নি।

খ. কত ইপিজেড গড়তে পারবে বাংলাদেশ?

অর্থনীতিতে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো— আরও বেশি পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা। এই লক্ষ্যে সরকার অনেক আগেই সারা দেশে অন্তত ১০০টি ইপিজেড (এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন) গড়ারও অঙ্গীকার করেছে।

মুশকিল হলো শতাধিক ইপিজেড গড়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার বেশির ভাগই এখনও দিনের আলো দেখেনি। বিশেষ করে ভারতের জন্য যে এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল, তা ভারতীয় শিল্পপতিদের বিশেষ পছন্দ হয়নি বিধায় সেগুলো নিয়েও বিশেষ কাজকর্ম এগোয়নি।

ভারতের অন্যতম শীর্ষ চেম্বার অব কমার্স (বণিকসভা) ফিকি-র এক শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘শুধুমাত্র ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশ চট্টগ্রামের মীরসরাই, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও বাগেরহাটের মংলার কাছে তিনটি ইপিজেড বানিয়ে দিতে চেয়েছিল।’(উল্লেখ্য,ভারতে ইপিজেডগুলো সচরাচর স্পেশাল ইকোনমিক জোন- এসইজেড বলে পরিচিত)

‘কিন্তু এই জায়গাগুলো যে আমাদের খুব একটা কাজে আসবে না, তা আমরা প্রায় বছর দেড়েক আগেই ভারত সরকারকে জানিয়ে দিয়েছি। চীন বা দক্ষিণ কোরিয়াকে যেমন ঢাকা বা চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে এসইজেড গড়তে দেওয়া হয়েছে, ভারতও সেই সুবিধা পেলে তবেই বাংলাদেশে ভারতীয় লগ্নি সহজে যেতে পারবে’, জানান ওই কর্মকর্তা।

ফলে বাংলাদেশের নতুন সরকার এই ইপিজেড কোথায় ও কিভাবে গড়ে তুলতে পারে, সে দিকে ভারতের সরকার ও শিল্পমহলও তুমুল আগ্রহ নিয়ে নজর রাখছে।

গ. অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব পড়বে রোহিঙ্গা সংকটের?

বিগত প্রায় দেড়বছর ধরে মিয়ানমার থেকে নতুন করে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল বাংলাদেশের জন্য যে বিরাট এক সংকট বয়ে এনেছে তাতে কোনও সংশয় নেই। আর সেটা শুধু কূটনীতিতে নয়, অর্থনীতিতেও।

ভারতে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরাও এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরা মোটেই সহজ হবে না। এই প্রক্রিয়ায় বহু বছর লেগে যেতে পারে, এমনকি তারা না-ও ফিরতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও একটা দীর্ঘমেয়াদী চাপ পড়বে অবধারিতভাবেই।

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনে’র বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারা টেলর যেমন বলছেন, ‘আমার আশঙ্কা রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস) অর্জন বিঘ্নিত ও বিলম্বিত হবে।’

শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ বিগত দশকে যে অভাবনীয় উন্নতি করেছে, সেই ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফেও কিন্তু এখন রোহিঙ্গা সংকট ধীরে ধীরে ছায়াপাত করছে। সারা টেলরও মনে করেন, বাংলাদেশ যেভাবে এলডিসি’র কাতার থেকে মধ্য আয়ের দেশে উঠে এসেছে, এর পরের ধাপে যাওয়াটা কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের কারণেই অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য সংস্থাগুলোর ত্রাণ বা বিদেশি অনুদানও ক্রমশ কমে আসবে, এটাও মোটামুটি জানা কথা। এই পরিস্থিতিতে ভারতও মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নতুন মেয়াদে রোহিঙ্গা সংকট কিভাবে সামলান, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

অল্প অল্প করে হলেও যদি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়, তাহলে তার সরকারের জন্য কাজটা কিছুটা সহজ হতে পারে। নইলে শুধু পরবর্তী পাঁচ বছর নয়, আরও অনেক দিন এই শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভোগাবে বলেই দিল্লিতে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

ঘ. কতটা জোরে পড়বে ‘ড্রাগনে’র নিঃশ্বাস?

তবে বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের এই মুহূর্তে প্রধান উৎকণ্ঠার কারণ যেটা, তা হলো শেখ হাসিনার নতুন সরকার অর্থনীতির নানা খাতে, বিশেষ করে বিগ-টিকিট অবকাঠামো প্রকল্পে কতটা চীনের দিকে ঝুঁকবে!

২০১৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা সফরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশকে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এতদিন চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রেখেই চলেছেন। কিন্তু নতুন মেয়াদে তিনি বেশি করে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারেন, দিল্লির মধ্যে এমন একটা ধারণা কাজ করছে।

যেমন, বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার) আর্থিক করিডোর নিয়ে বাংলাদেশ ইদানিং যে প্রবল উৎসাহ দেখাচ্ছে— ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা তাতে রীতিমতো অশনি সংকেত দেখছেন।

চীন যেহেতু অধুনা বিসিআইএম-কে তাদের ‘বেল্ট রোড’ প্রকল্পের অংশ হিসেবেই তুলে ধরছে এবং কাশ্মীরের কারণে ভারত বেল্ট রোডের তুমুল বিরোধী, তাই বাংলাদেশকে এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যে, বিসিআইএম-কে বেল্ট রোড থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে দেখা হলে তবেই ভারত এই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হতে পারবে, নচেত নয়।

কলকাতা-ঢাকা-মান্দালে-কুনমিং পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রস্তাবিত করিডোর নিয়ে আলোচনায় ভারতের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক কূটনীতিবিদ ও ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রজিত মিটার।

তিনিও এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘বেল্ট রোডের বয়স তো সবে দু-তিনবছর হলো। বিসিআইএম নিয়ে কিন্তু প্রায় কুড়ি বছর ধরে কথাবার্তা চলছে এবং দুটোকে এক করে দেখার কোনও সুযোগ নেই— এটাই আমাদের বিশ্বাস।’

চীনের ঋণ নেওয়ার পর শ্রীলঙ্কা কিভাবে হাম্বানটোটা বন্দর নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে, অথবা মালয়েশিয়া ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে চীনা রেল প্রকল্প বাতিল করেছে, সেগুলোও সুক্ষ্মভাবে বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে ভারত।

সোজা কথায়, আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব কতটা বড় হয়ে দেখা দেয় এবং বাংলাদেশ কিভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে সামলায়, ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে উঠছে।