বণিক বার্তাঃ

মাত্র সাড়ে ছয় হাজার একর জায়গা। ১৯৯১ সালে অস্থায়ীভাবে চালু হয় মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে। ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালংয়ের এ আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিল মাত্র ৩৪ হাজার। ওই বছরের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানের পর চাপ বাড়তে থাকে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে কুতুপালং উদ্বাস্তু শিবিরটিতে অবস্থান করছে প্রায় ৮ লাখ ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। এত বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু বিশ্বের আর কোনো শিবিরেই নেই। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির।

স্বল্প জায়গায় ত্রিপল আচ্ছাদিত বাঁশের কাঠামোর ছোট ছোট ঘরেই কোনোমতে থাকতে হচ্ছে উদ্বাস্তুদের। সংকট আছে পানিরও। কুতুপালং ক্যাম্পে সাড়ে ২০ হাজারের বেশি নলকূপ বসানো হয়েছে। স্বল্প জায়গায় এত বিপুলসংখ্যক নলকূপ থেকে পানি উত্তোলনের ফলে দ্রুত নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ক্যাম্পের পাশের ছোট নালা-খালের ময়লা পানিতেই ভরসা রাখতে হচ্ছে অনেক সময়।

পানির মতোই তীব্র জ্বালানি সংকটও রয়েছে কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। এর কাছাকাছি জ্বালানি কাঠ যা ছিল, কয়েক মাসের ব্যবধানে তা শেষ হয়ে গেছে। এখন ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলোই কাঠ সংগ্রহের শেষ ভরসা। কেউ কেউ সকালে কাঠের সন্ধানে বেরিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছেন। বসতি গড়ার পাশাপাশি জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারের কারণে উজাড় হচ্ছে বনভূমি। বন বিভাগের হিসাবেই গত বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ১ হাজার ১৯৯ একর বনভূমির সৃজিত বন (সামাজিক বনায়ন) ও ২ হাজার ৩১৮ একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে খাবারের চাহিদা পূরণ হলেও পুষ্টির চাহিদা মিটছে না। এর শিকার হচ্ছে শিশুরা। পুষ্টিহীনতায় ভুগছে কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা পরিবারের শিশুদের বড় অংশ। শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি শৈশব হারিয়ে বড় হচ্ছে তারা। শিশুদের পাশাপাশি নানা রোগ-ব্যাধিতে ভুগছে বড়রাও। ফেরার অনিশ্চয়তা নিয়ে এভাবেই আশ্রয় শিবিরে দিন কাটছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সি আর আবরার এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্বব্যাপী বড় বড় মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান থাকার পরও মিয়ানমারের মতো একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র বছরের পর বছর তার নিজ নাগরিকদের দেশ থেকে বের করে শরণার্থী বানিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি বিষয়টি নিয়ে বড় বড় কথা বলছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোও নিজেদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে এত বড় একটা অন্যায় উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এভাবে আমরা সভ্যতার দাবি করতে পারি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, মানবসভ্যতা ৩০০-৪০০ বছর আগে ফেরত যাচ্ছে, যার রিফ্লেক্স হিসেবে কুতুপালংয়ের মতো বড় বড় উদ্বাস্তু শিবির গড়ে উঠছে।

তিনি বলেন, এ বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা আসার কারণে কোনোভাবে দোষী না হয়েও এর দায় বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে, যা আসলে কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসনের জন্য ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারকে দেয়া হয়। যাচাই-বাছাই শেষে তারা সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার বিষয়ে ছাড়পত্র দেয়। ছাড়পত্র পাওয়া এসব রোহিঙ্গাকে নিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। পরে তা আর হয়নি।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, আশ্রিতের সংখ্যার হিসাবে কুতুপালংয়ের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবির হলো উত্তর-পশ্চিম উগান্ডার বিডি বিডি। দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষ ২০১৩ সালে এ শিবিরে আশ্রয় নিতে শুরু করে। বর্তমানে সেখানে বসবাসরত উদ্বাস্তুর সংখ্যা ২ লাখ ৮৫ হাজার।

২০১৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার আগে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবিরটি ছিল কেনিয়ার দাদাব রিফিউজি কমপ্লেক্স, বর্তমানে এটি তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ১২৬ জন। বর্তমানে সেখানে আশ্রিত রয়েছে সোমালিয়ার ২ লাখ ৩৫ হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ।

চতুর্থ বৃহৎ উদ্বাস্তু শিবিরটিও কেনিয়ায়। উত্তর-পশ্চিম কেনিয়ার কাকুমা আশ্রয় শিবিরটি ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এ শিবিরে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫০। তাদের সবাই সুদান থেকে বিতাড়িত। আর ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩০ জন আশ্রিত নিয়ে পঞ্চম বৃহৎ উদ্বাস্তু শিবির তানজানিয়ার নায়ারুগুসু।

আশ্রিতের সংখ্যায় বিশ্বের সব উদ্বাস্তু শিবিরকে ছাড়িয়ে যাওয়া কুতুপালং আশ্রয় শিবিরটি অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয় ১৯৯১ সালে। সে সময়ও বার্মার (মিয়ানমারের সাবেক নাম) সামরিক বাহিনীর অপারেশন পি থায়ারের (অপারেশন ক্লিন আপ অ্যান্ড বিউটিফুল ন্যাশন) শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছিল হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত উদ্বাস্তু শিবিরটিতে সেই থেকে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে এ নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনের পরিস্থিতি এখনো অনুকূল নয়। জোর করে ফেরত পাঠানো হতে পারে, এ আতঙ্কে অনেক রোহিঙ্গা এরই মধ্যে ক্যাম্প ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। নিজের ইচ্ছায় ফিরতে না চাইলে তাদের জোরপূর্বক সেখানে পাঠানো সম্ভব নয়। এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। এ অবস্থায় আতঙ্কে পালিয়ে বেড়ানো রোহিঙ্গারা এখন ক্যাম্পে আসতে শুরু করেছে।

সরেজমিন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে পাঠানো হতে পারে, এ ভয়ে ক্যাম্পের পিয়ার মোহাম্মদ ও নুরুল আমিনের পরিবার ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

রোহিঙ্গা নেতা আবু ছিদ্দিক জানান, ক্যাম্পে এমন কিছু গ্রুপ তৈরি হয়েছে, যারা ছাড়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার কেউ রাখাইনে ফিরতে রাজি হলে তাকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয়া হচ্ছে। তবে কিছু পরিবার স্বদেশে চলে যেতে চায়। কিন্তু ওইসব গ্রুপের ভয়ে তারা কথা বলতে পারছে না। এসব কারণে অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেলেও এখন তারা ফেরত আসছে।

জানা যায়, প্রত্যাবাসনের জন্য দ্বিতীয় দফায় আরো ২২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে দিয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে এখনো তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রথম দফায় সাড়ে আট হাজারের মধ্যে সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গার ছাড়পত্রের বিষয়েও কিছু জানায়নি দেশটি। ছাড়পত্র না পেলেও তালিকাভুক্ত হওয়ায় এসব রোহিঙ্গার অনেকের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় আসে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানান, এখনো কিছু জটিলতা রয়ে গেছে। সেগুলো নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা। সব সমস্যা মোকাবেলা করে শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে তার আশা। তবে জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না।