আলমগীর মানিক,রাঙামাটি:

জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছুদিন শান্ত থাকার পর আবারো হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য পরিস্থিতি। গত কয়েকদিনে পার্বত্য তিন জেলায় একের পর এক আইনশৃঙ্খলার প্রতি হুমকিপুর্ণ কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে স্বাভাবিক আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবারও আশঙ্কা করছে পর্যবেক্ষক মহল। একইদিনে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পাহাড়ে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার পাশাপাশি বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় আবারো ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসন যন্ত্রকে। উপজাতীয় সশস্ত্র এসকল সন্ত্রাসী গোষ্ঠির ভাতৃঘাতি সংঘর্ষসহ সশস্ত্র তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে শীর্ঘ্রই পাহাড়ে সাড়াঁশি অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির। এদিকে এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পাহাড়ে আইন শৃংঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পার্বত্য এলাকায় পুলিশ ক্যাম্প বৃদ্ধির দাবিও উঠেছে।

দেশের এক দশমাংশ এলাকার আয়তন নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তথাকথিত অধিকার আদায়ের নামে গঠিত আঞ্চলিক দলগুলো তাদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থেকে স্থানীয়দের কাছ থেকে আদায় করা বিপুল পরিমাণ চাঁদার টাকার ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে একের পর খুন, হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি-অস্ত্রবাজিতে লিপ্ত রয়েছে। গত ১০দিনে পাহাড়ে তিনটি ঘটনায় ৭জন অপহরণ, ৬টি গুলি বিনিময়ের ঘটনাসহ সশস্ত্র সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্রসহ স্থানীয় সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানাগেছে, মঙ্গলবার ২৯ জানুয়ারি লংগদু উপজেলার সদর ইউনিয়নের ভূইয়োছড়া গ্রামে পবিত্র চাকমা ওরফে তোষণ নামে ৪২ বছর বয়সী এক ইউপিডিএফ সদস্যকে খুন করা হয়েছে। দুুুপুর ১টার দিকে পবিত্র চাকমা ও অন্য একজন ইউপিডিএফ সদস্য সাংগঠনিক কাজে ভূইয়োছড়ায় (ডানে লংগুদু) গেলে মহালছড়ির মুবাছড়ি থেকে এসে ১০-১২ জন প্রতিপক্ষের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের উপর অতর্কিত গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে পবিত্র চাকমা নিহত হন, তবে অন্যজন অক্ষত অবস্থায় নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সক্ষম হন।’ পবিত্র চাকমা ঘটনাস্থল ভূইয়োছড়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম ধর্মপাড়ার বাসিন্দা এবং শান্তি প্রিয় চাকমার ছেলে। তিনি ২০০১ সাল থেকে ইউপিডিএফে একনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন বলে অভিযোগ করেছে তার দল। একই দিন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ইউপিডিএফ (প্রসীত) ও জেএসএস (সংস্কার)’র মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে বলে জানা গেছে। জানাযায়, ২৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে মহালছড়ির হাজাছড়ায় ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) এর ২ গ্রুপের মধ্যে প্রায় ঘন্টাব্যাপী গোলাগুলি হয়, তবে কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। খবর নিরাপত্তাবাহিনীর টহল টিম ঘটনাস্থলে গিয়েছে এবং বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলেও জানা গেছে। এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদী থেকে মোঃ বাচ্চু মিয়া(২৮) নামে এক ব্যক্তির হাত বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ২৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে নদীতে হাত বাঁধা একটি লাশ ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দেয় এলাকাবাসী। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। বাচ্চু মিয়া জেলা সদরস্থ সিঙ্গীনালার মোঃ আবুল হোসেনের ছেলে। এদিকে, ২৭শে জানুয়ারী রাঙামাটির বাঘাইছড়ি বঙ্গতলী এলাকায়ও আঞ্চলিক দুটি দলের মধ্যে গুলি বিনিময় চলে ঘন্টাব্যাপী। এতে কেউ হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

১৯শে জানুয়ারী খাগড়াছড়িতে দুর্বৃত্তের গুলিতে পিপলু বৈষ্ণব ত্রিপুরা ওরফে রনি নামে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের কর্মী নিহত হয়েছে। শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে জেলা সদরের গাছবানমুখ এলাকায় দুর্বৃত্তরা তাকে নিজ বাড়িতে গুলি করে পালিয়ে যায়। নিহত রনি খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার বল্টুরাম এলাকার মৃত নিগমানন্দ বৈষ্ণব ত্রিপুরার ছেলে।

এদিকে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহকে মুঠোফোনে কল করে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিয়েছে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা। ২৮ জানুয়ারি সোমবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহকে একটি মোবাইল নাম্বার হতে সকালে ২ বার কল দিলে, তিনি (ইউএনও) কল রিসিভ করলেও কোন কথা বলেন নি। পরবর্তীতে পুনরায় একই নম্বর হতে ইউএনওকে কল দিয়ে হুমকি প্রদান করা হয়। ফোনের ওপাশ থেকে ইউএনওকে বলা হয়, সে ভিতরের পার্টির( আঞ্চলিক সংগঠন) লোক এবং তাদেরকে টাকা দিতে হবে। এই বলে ফোন কেটে দেয়। এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপের জন্য দীঘিনালা থানাকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের একটি সূত্র। দীঘিনালার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্ল্যাহ, হুমকির বিষয়টি নিশ্চিত করে সংবাদ মাধ্যমকে জানান ওটা কিছু না, তাছাড়া থানায় অবগত করেছি, তারা দেখছে বিষয়টা।

এদিকে, পাহাড়ে চলমান এসকল সন্ত্রাসী ঘটনায় জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জেলার বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে অস্ত্রসহ এক চাঁদাবাজকে আটক করেছে যৌথবাহিনী। সোমবার রাত সাড়ে ১১টার সময় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কাপ্তাইয়ের পূর্ব ভাল্লুকিয়া পাড়া থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২৮ জানুয়ারী যৌথবাহিনী রাঙামাটির গুদাম ঘর তল্লাশি করে সবিমল তংচঙ্গ্যা(৫৭) নামের এই চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করে। এসময় তার কাছ থেকে একটি দেশীয় এলজি ও দুই রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।

২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে জেলা শহরের ক্রিয়েটিভ কম্পিউটারে চাঁদাবাজির পরিকল্পনা করার সময় গাছবান এলাকার ২ নং প্রকল্প পাড়ার গোবিন্দ ত্রিপুরার ছেলে অর্জুন কুমার ত্রিপুরা (২৬) ও একই এলাকার মৃত অনিল কুমার ত্রিপুরার ছেলে চন্দ্র মোহন ত্রিপুরা (২৫)কে ১টি এলজি, ২ রাউন্ড এ্যামো, ১টি মোটরসাইকেল, নগদ ১৩ শত ২টাকা, ২টি মোবাইল ফোন, চাঁদা আদায়ের রশিদ ২টি ও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ আটক করেছে খাগড়াছড়ি সদর জোনের (বিজয়ী বাইশ) সেনা সদস্যরা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা নিজেদের ইউপিডিএফ সদস্য পরিচয় দিয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

গত ২৫শে জানুয়ারী পার্বত্য বান্দরবানের রুমায় চার কাঠ কাটার শ্রমিককে অপহরণ করে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। অপহরণের পর আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে তারা। শুক্রবার বিকালে দিকে তাদের অপহরণ করা হয়। অপহৃতরা হলেন, বান্দরবান পৌর এলাকার বালাঘাটা এলাকার শ্রমিক মো. নুরুল আলম (৪৮), কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার টইটংয়ের মো. জমির হোসেন (৩৯), চট্টগ্রামের চন্দনাইশের আহম্মদ কবির (৪৬) ও মো. আনসার আলী (৩৫)। এই ঘটনার পর সেনা অভিযানের মাধ্যমে ২৮শে জানুয়ারী উক্ত অপহৃত চারজনকে উদ্ধার করা হয়।

উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেছেন, আমরা গুটি কয়েক সন্ত্রাসীদের কাছে পাহাড়ের মানুষ জিম্মি থাকতে পারে না। এই ধরনের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে এবং কয়েকদিনে এর দৃশ্যমান চিত্রও স্পষ্ট রয়েছে। জনাব আলমগীর কবির জানান, আমরা শীঘ্রই পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাড়াঁশি অভিযান শুরু করবো। জানমালের ক্ষতিসাধনসহ জননিরাপত্তা বিঘœ সৃষ্টিকারি সকলেই সন্ত্রাসী এই বিবেচনায় নিরাপত্তা বাহিনী জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং শীঘ্রই এটা পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত সন্ত্রাসীরা টের পাবে বলেও মন্তব্য করেছেন সদ্য পিপিএম পদক প্রাপ্ত রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির।

এদিকে পাহাড়ে চলমান সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে আরো কঠোর আহবান জানিয়েছেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মূছা মাতব্বর। প্রতিবেদককে তিনি জানান, আমাদের পার্বত্যাঞ্চলের অরক্ষিত সীমান্ত সুরক্ষাসহ অত্রাঞ্চলের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় পুলিশ ও বিজিবি’র ক্যাম্প বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।