ইলিশে রেকর্ড

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারী, ২০১৯ ১১:৫৪

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


আতিকুর রহমান মানিক

গত এক সপ্তাহ ধরে রূপালী ইলিশে সয়লাব কক্সবাজার শহর ও জেলার মফস্বল হাট বাজার। বাজার ছাড়াও পাড়া মহল্লায় ফেরি করে বিক্রি করা হচ্ছে ইলিশ মাছ। কক্সবাজার ও টেকনাফ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিদিন ইলিশ বোঝাই করে ফিরছে ফিশিং ট্রলারগুলো। এভাবেই ব্যাপক আকারে উৎপাদন বেড়েছে জাতীয় মাছ ইলিশের।
এর ফলে ইলিশ আহরণে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২১ হাজার টন বেশি। মৎস্য অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম। দেশে ইলিশ উৎপাদনের এই রেকর্ড বিশ্বে প্রথম স্থানকে আরো সুসংহত করল।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, গত ১০ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার টন। এবার তা ৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সুরক্ষিত হওয়ায় এবং জাটকা ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখার কারণে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মা ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় মাঠপর্যায়ে এর সুফল পাওয়া গেছে। এর ফলে ইলিশ উত্পাদন ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ ইলিশ। এছাড়া বর্তমানে দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে এই জাতীয় মাছটি।

বিএফআরআই-এর তথ্য মতে, ইলিশ মাছ সারা বছরই কমবেশি ডিম ছাড়ে। তবে প্রধান প্রজনন মৌসুম হচ্ছে আশ্বিন (অক্টোবর) মাস। প্রাথমিক গবেষণার ভিত্তিতে ইতিপূর্বে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে ও পরের ১০ থেকে ১৫ দিন মা ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা হলেও ২০১৬ সালে তা ২২ দিন করা হয়েছে- যা ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

বিএফআরআই-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২২ দিন মা ইলিশ সুরক্ষিত হওয়ায় ডিম দেওয়া ইলিশের হার ছিল ৪৬.৪৭ শতাংশ – যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয়েছে ৪৭.৭৪ শতাংশ। এতে করে ২০১৭-১৮ আর্থিক সালে ৩৬ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। ওই সময়ে ইলিশ মাছ ডিম দিয়েছে ৭ লাখ ২৮ হাজার কেজি। অথচ ২০০৮-০৯ সালে যখন ১১ দিন মা ইলিশ আহরণ বন্ধ ছিল তখন ডিম দেওয়া ইলিশের হার ছিল মাত্র ১৭.৬২ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ইলিশ প্রধানত ডিম ছাড়ে। এজন্য চলতি বছরে আশ্বিনের বড় পূণির্মার দিনসহ পূর্বের ১৭ দিন এবং পরের ৪ দিন (১৭+১+৪) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর সুফলও মিলেছে ইলিশের মোট উৎপাদনে। দেশে ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির পিছনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরে বরিশাল সদর, হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ৮২ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে অধিক পরিমাণে জাটকা সুরক্ষিত হওয়ায় চলতি অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়বে বলে গবেষকরা মনে করছেন। উল্লেখ্য, পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড।
বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০ শতাংশ বাংলাদেশ আহরণ করে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫ শতাংশ) এবং ৩য় অবস্থানে ভারত (১০-১৫ শতাংশ)। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

প্রকৃতি সবসময়ই উদার। প্রকৃতির নিজস্ব গতিকে বাঁধাগ্রস্হ না করলে দু হাত উপুড় করে ঢেলে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা কার্যক্রম, নিষিদ্ধ জাল ধ্বংসকরন অভিযান ও জেলেদের সচেতনকরন কার্যক্রমের সুফল এখন মিলছে। ইলিশের উৎপাদন এখন বেড়েছে ও আহরনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। নদ-নদী ও সাগর মোহনা থেকে অবৈধ জাল ধ্বংস করা গেলে ইলিশ ও অন্যান্য সব প্রজাতির মাছের উৎপাদন বাড়বে। সামনে সোনালী দিন, অপেক্ষায় সবাই।