আবু তৈয়ব বাপ্পী

“রোদ উঠে গেছে তোমাদের নগরীতে আলো এসে থেমে গেছে তোমাদের জানালায়” তুহিনের সুরে গাওয়া হাসি মুখে গানটা শুনছিলাম তখন। গানের লিরিক্সে রোদ উঠলেও তখেও আমাদের নগরীতে রৌদ উঠে নি। কুয়াশার চাদরে ডেকে আছে আমাদের নগরী। কুয়াশার বিন্দু বিন্দু জলে ভিজে চুপসে গেছে নগরীর পিচ ঢালা রাস্তা। আগের রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগপ্যাক কাঁধে চেপে আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছি বহদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ডের দিকে, এবারের গন্তব্য কুতুবদিয়া। চট্রগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত ছোট একটি উপজেলা কুতুবদিয়া।

ধারণা করা হয়,পঞ্চদশ শতাব্দীতে হযরত কুতুব উদ্দিন নামের এক কামেল ব্যাক্তির আগমন ঘটে এই দ্বীপে। আর এই কামেল ব্যাক্তির নাম অনুসারে এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে “কুতুবদিয়া “। ৮৩.৩২ বর্গমাইলের এই ছোট্ট এই দ্বীপ আমার কাছে খুবই প্রিয়। এই দ্বীপের বসবাসরত প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ আমার কাছে খুব পছন্দের। স্রষ্টা এই দ্বীপকে এমন অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়েছেন যে মানুষের কাছে প্রিয় না হয়ে উপায় নেই! আর এই দ্বীপের মানুষের ভালোবাসা, আদর,আথিতেয়তা পেয়ে মনে হয় মানুষ গুলো আমার খুব কাছের। কুতুবদিয়া ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য লিখার চেষ্টা করবো আমি দর্শনীয় স্থান – বাতিঘর : বহু বছর আগে সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজের নাবিকদের পথ দেখাতে তৈরি করা হয়েছিল এই বাতিঘর। তবে কালের পরিক্রমায় বাতিঘর সমুদ্রে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তবে বড়ঘোপ বাজার থেকে সমুদ্র সৈকত ধরে উত্তর দিকে কিছু দূর হেটে গেলে আপনি বর্তমান বাতিঘরের দেখতে পাবেন | কিন্ত, আপনি অবশ্যই অবশ্যই পুরোনো বাতিঘর দেখতে যাবেন কারণ পুরোনা বাতিঘরের পাশেই রয়েছে ঝাউবন ও নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত | এই সমুদ্রসৈকতে আপনার সঙ্গী হবে গাঙচিল | সূর্য অস্ত ও গাঙচিলের মেলা দেখবেন এই নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতে বসে |

বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র : বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় এক হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় এই কেন্দ্র থেকে | এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প | কুতুবদিয়া গিয়ে বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে না গেলে আপনার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে |

কুতুব আউলিয়ার দরবার : ১৯১১ সালে এই ছোট্ট দ্বীপে জম্ম গ্রহণ করেন হযরত আবদুল মালেক শাহ্ আল-কুতুবী মুহিউদ্দিন আজমী (রাঃ) | তিনিই কুতুব আউলিয়ার দরবারের প্রতিষ্ঠাতা | ২০০০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি মারা যান | আমি কুতুবদিয়া গেলে সর্বপ্রথম মাজার জেয়ারত করেই বাকি কাজ শুরু করি |

শুঁটকি পল্লী : আপনি কুতুবদিয়া যাবেন কিন্তু শুঁটকি আনবেন না? তা হবে না,তা হবে না (হাসি) | আপনি যদি আমার মতো শুঁটকি প্রিয় হয়ে থাকেন তাহলে কুতুবদিয়া আপনার কাছে স্বর্গ তুল্য মনে হবে | বায়ুকুল অর্থাৎ আপনি যখন বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাবেন তার পাশেই রয়েছে বিশাল শুঁটকি পল্লী | আপনি শত রকমের শুঁটকি দেখে অবাক হবেন | শুঁটকি পল্লীতে যাবেনই যখন তখন অল্প দামে বেশি করে ভাল শুঁটকি কিনতে ভুলবেন না | আপনি যদি এক দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে যান তাহলে সন্ধ্যার ভিতর এই স্থান গুলো ঘুরে নিতে পারবেন | আর আপনি যদি ১ রাত থাকতে চান তাহলে আপনি ঘুরে বেড়ানোর জন্য দুই দিন সময় পাবেন | দ্বিতীয় দিন যে স্থান গুলোতে আপনি ঘুরতে পারবেন তার একটা ছোট্ট তালিকা দিচ্ছি

* কুতুব আউলিয়ার মাজার * কালারমার মসজিদ * ফকিরা মসজিদ * সিটিজেন পার্ক * শহীদ মিনার * বড়ঘোপ স্টেডিয়াম * প্রাচীন দীঘির পাড় (বড়ঘোপ),ইত্যাদি |

লবণ তৈরীর মাঠ নিয়ে আলাদা ভাবে কিছু বল্লাম না কারণ যে দিকে চোখ যায় ঐদিকে লবণের মাঠ দেখবেন | আর অবশ্যই লবণের মাঠ থেকে একটু লবণ খেয়ে দেখবেন | বায়ু বিদ্যুৎ ,বড়ঘোপ সবখানেই আপনি বিশাল বিশাল বীচ পাবেন | বীচ নিয়েও বিশেষ কিছু উল্লেখ করছি না | যাতায়াত বেশ কয়েকটি সড়কপথ ও নৌপথ যোগে কুতুবদিয়া যেতে পারবেন | তবে আমি সহজ পথটা লিখছি | প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে রাস্তা দিয়েই যান না কেন আপনাকে নৌকার সাহায্য নিতে হবেই | অনেকেই নৌকার চড়তে হয় বলে ভয় পান, ভয়ের কিছু নাই | প্রথমেই বহদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ড থেকে মগনামাগামী বাসে উঠবেন | বাস ভাড়া ১৫০ টাকা নিবে | সময় ২ ঘন্টা মতো লাগতে পারে | রাস্তার অবস্থা বুঝে কম বেশি হতে পারে | মগনামা বাস থেকে নেমে ঘাটে যাবেন (ঘাট = যে স্থান থেকে নৌকা ছেড়ে যায়) | তারপর মগনামা ঘাট থেকে দরবার ঘাট (কুতুবদিয়া) | বলে রাখা ভাল আপনি ঘাটে দুই ধরনের নৌকা দেখতে পাবেন | বড় নৌকা (স্থানীয় ভাষায় ‘ডেনিস’ বলে ) ও স্প্রিট বোট | বড় নৌকাতে করে গেলে আপনার সময় লাগবে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট | ভাড়া নিবে ৩০ থেকে ৪০ টাকা | আর যদি স্প্রিট বোটে করে যান তাহলে আপনার সময় লাগবে ৬-৭ মিনিট | ভাড়া ৮০ টাকা|

কুতুবদিয়া পৌছানোর পরে স্থানীয় যানবাহনের সাহায্যে আপনি দর্শনীয় স্থান গুলো ঘুরে দেখতে পারবেন খুব সহজে | আপনি গাড়ি চালকদের সাথে একটু একটু গল্প করার চেষ্টা করবেন, দেখবেন এরাই আপনার ভ্রমণটা অনেকটা সহজ করে দিবে | খাওয়া ও থাকা | আপনি জীবনে তো অনেক জায়গায় অনেক দাম দিয়ে খাবার কিনে খেয়েছেন | কুতুবদিয়া গিয়ে দুপুরে একবেলা ভাত কুতুবদিয়া দরবারে খাবেন | তাও ফ্রি ! এই খাবারে স্বাদ আপনাকে কুতুবদিয়া নিয়ে যাবে বার বার | বেশি বেশি করে সামুদ্ররিক মাছ খাবেন | ঐখানে মাছ খাওয়ার পর বুঝতে পারবেন শহরে এত দিন কী খেয়েছিলেন…!!!

রাত্রি যাপনের জন্য সমুদ্র বিলাস একটি মাত্র ভাল মানের হোটেল রয়েছে | এখানেই থাকতে পারবেন | আর আপনার বাজেট যদি কম হয় তাহলে ফ্রি কুতুবদিয়া দরবারে থাকতে পারবেন |

উপরের সকল তথ্য আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি | এই অল্প তথ্য আপনার কুতুবদিয়া ভ্রমণের সহায়ক হবে বলে আশা করছি | জেনে রাখুন – বর্ষাকালে না যাওয়াই উত্তম | – কুতুবদিয়াতে বিদ্যুৎ নেই। তো চিন্তার কোনো কারণ নেই, সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে আপনার সকল ডিভাইস চার্জ দিতে পারবেন | – শুঁটকি বাজার থেকে কিনবেন না ভুলেও |পল্লী থেকেই কিনবেন শুটকি | সকলের ভ্রমণ সুন্দর ও নিরাপদ হোক।

লেখক: আবু তৈয়ব বাপ্পী, মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠক চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।