#মাহ্ফুজুল হক:
স্থানীয় একটি দৈনিক গত ৯ জানুয়ারী, ২০১৯, বুধবার একটি উদ্বেগজনক খবর ছেপেছে। পাঠক প্রিয় অনলাইন কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)-এও একই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ‘গণহারে স্থানীয়দের ছাঁটাই করছে এনজিও সংস্থা’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে, ‘কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত স্থানীয়দের চাকরী থেকে ছাঁটাই চলছে। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ এনজিও থেকে স্থানীয় কোটায় চাকরী পাওয়াদের ছাঁটাই করে ফেলেছে। আর কিছু সংখ্যক যারা আছে তারাও নিম্নপদস্থ। মূলত প্রজেক্ট শেষ, বাজেট বরাদ্দ না থাকা এবং স্থানীয়দের মধ্যে যোগ্য লোক না থাকার কথা বলে স্থানীয়দের চাকরী থেকে গণহারে ছাঁটাই করছে এনজিও সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা।’ সংবাদে সম্প্রতি ছাঁটাই হতে যাওয়া নুরুল আবছার নামক এক কর্মীর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘…বিষয়টি নিয়ে আমরা সেই এনজিও’র উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বলছে দাতা সংস্থার বাজেট বরাদ্দ শেষ হয়েছে। তাই প্রজেক্ট চলবে না আর যদি কোন মতে চলে তাও খুব সীমিতভাবে চলবে তাই অনেককে চাকরীতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সেই এনজিওতে স্থানীয় ছাড়া আরো কমপক্ষে ৫০ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট আতœীয়-স্বজন আছে যারা বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে এসেছে কিন্তু তাদের কারো চাকরী যায়নি সবাই ঠিকই আছে। শুধু আমরা যারা স্থানীয় আছি আমাদের চাকরী নাই।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এমএসএফ এনজিওতে কর্মরত অন্তত ১০ জন স্থানীয় যুবক যুবতী বলেন, ‘গত ২ দিনে আমাদের ৫০ জনের মত স্থানীয়দের বলে দিয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত আমাদের চাকরী আছে পরের মাসে নাই এবং আমাদের স্থলে তারা রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দেবে।’

উখিয়া সুজন সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ‘… আমার প্রশ্ন হচ্ছে যদি ১০০ জনের মধ্যে ২৫ জন স্থানীয় থাকে ৭৫ জন বাইরের তাহলে ছাঁটাই করতে হলে রেসিও অনুযায়ী করতে হবে অর্থাৎ ১০ জন স্থানীয় বাদ পড়লে ৩৫ জন বাইরের চাকরীজীবি বাদ পড়বে কিন্তু সেটা না করে ২৫ জনই স্থানীয় বাদ পড়ছে।’ কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মুর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘আমি শুনেছি অনেক স্থানীয়দের চাকরী থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এটা শুধু আজকে নয় পান থেকে চুন খসলেই স্থানীয়দের চাকরী থাকে না। আর বহিরাগতরা অনায়াসেই থাকে। বর্তমানে প্রজেক্ট শেষ, বাজেট সংকট, যোগ্য লোক নাই এ সমস্ত বাজে কথা বলে স্থানীয়দের ছাঁটাই করা হচ্ছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো স্থানীয় এনজিওদের সাথে চুক্তি করে কাজ করার নিয়ম থাকলেও সেটা মানছে না। তারা নিজেরা বাইরে থেকে এনজিও হাইয়ার করে এনে তাদের সাথে কাজ করে এতে নানান ধরণের অনিয়ম করে। আর স্থানীয়দের নানান ভাবে বঞ্চিত করে।’ এ ব্যাপারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ আবুল কালাম বলেন, ‘স্থানীয়দের বাদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের চাকরী দেওয়ার কোন সুযোগ নাই।’

বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানা ঘেঁষা পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ট দেশ মিয়ানমার (সাবেক বার্মা) সেখানকার রাখাইন স্টেটে (সাবেক আরাকান স্টেট) হাজার বছর ধরে বসবাসরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠিকে জোরপূর্বক তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য করে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠি ৮ম শতক থেকে সেখানকার বাসিন্দা হলেও উগ্রবাদী মগ, বৌদ্ধ ঠাকুর (ভিক্ষু), শাসক শ্রেণি ও সামরিক জান্তা দু’শতাধিক বছর ধরে তাদের উপর নির্মম, অমানুষিক জুলুম-নির্যাতন, খুন-জখম, লুটপাট চালিয়ে তাদের পিতৃ-মাতৃভূমি ছেড়ে পরবাসী হতে বাধ্য করে আসছে। বিভিন্ন ছল-ছূতায় অনির্দিষ্ট বিরতিতে তারা এহেন তান্ডব চালায়। তারই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গারা গত বছর অগাস্ট মাসে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আমাদের কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ উপজেলার প্রায় ৩২টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এছাড়াও কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে তাদের সংখ্যা ১১ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। (An estimated 1.1 million Rohingya people fled to Bangladesh from August 2017 and took shelter mostly in Cox’s Bazaar district and some in Bandarban. Source : POLICY RESEARCH INSTITUTE (PRI) OF BANGLADESH, COX’S BAZAR, 7 MAY 2018) উখিয়া উপজেলায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারা সেখানকার মোট স্থানীয় জনসংখ্যার চাইতে ৩গুণ বেশি। (Rohingya refugees in Ukhiya upazila is estimated about three times the local population.) কক্সবাজার জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের ৩ ভাগের একভাগই হচ্ছে রোহিঙ্গা। (Rohingya refugees are at least one third of the host population in Cox’s Bazar.) অর্থাৎ আমরা এখন নিজেদের ঘরেই সংখ্যালঘু।

মাত্র ৯৬২.১১ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট কক্সবাজার জেলার মতো বন-পাহাড়-সাগর পরিবেষ্টিত একটি সংকীর্ণ স্থানে এমনিতেই চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অতি নগণ্য যার উৎপাদন দিয়ে অত্র এলাকার প্রায় ২৩ লক্ষ স্থায়ী বাসিন্দাদেরই ভরণ-পোষণ হয় না। বিগত দেড় বছর ধরে কক্সবাজারবাসীর উপর জবরদস্তী চেপে বসা বিশাল আকারের বাড়তি জনসংখ্যার ভারে আমরা এখন ন্যূজ। সীমিত রুজির উপর বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের চাপ, উপার্জন না বাড়া, কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট, খাদ্য-দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, পুষ্টিহীনতা, সর্বোপরি সাধারণভাবে দারিদ্র্য বৃদ্ধি- এ সকল আকাল এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী। কথাগুলো আমি বানিয়ে বলছি না। জাতিসংঘসহ অপরাপর সংস্থাগুলো মিলে সম্প্রতি যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে তাতেই তা বর্ণিত হয়েছে। তারা বলছেন, অত্র এলাকার ৩৩৬,০০০ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বরাদ্দকৃত মানবিক সহায়তার ২৫ শতাংশ স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করার জন্য তারা এখন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন। দেখুন Joint Response Plan (JRP) Kx ej‡Q- Under the 2018 Joint Response Plan (JRP), 25% of the humanitarian assistance provided is targeted to host communities affected by the refugee influx. In this context humanitarian support and programs aim to reach some 336,000 people in need. The JRP has adopted an inclusive needs-based approach in its programs to support affected host communities. Critical interventions are extended to the most vulnerable families many of whom are facing similar challenges as those faced by newly arriving refugees (lack or limited income, access to job opportunities, food, nutrition services and general poverty). The strategy fully recognizes that both refugee and host community populations are poor and in need of humanitarian assistance. In this context, projects aim to mitigate the impact of the refugee influx on the local economy; strengthen resilience of affected host populations and improve government service delivery to reduce tensions between host and refugee communities through social cohesion programs that promote peaceful-coexistence. JRP programs are strengthening government institutions and systems in the areas of health and nutrition, water and sanitation, education, agriculture, forestry and environment. (https://www.humanitarianresponse.info/en/operations/bangladesh)

এখানকার জনগনের আর্থ-সামাজিক দুর্গতির কথাও তাদের রিপোর্টে উঠে এসেছে- খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতি ৫টি পরিবারের মধ্যে ১টি পরিবারের অবস্থা এতোই শোচনীয় যা সারা বাংলাদেশের গড় অবস্থার চাইতেও খারাপ। এটি শরণার্থী আগমনের আগের পরিস্থিতি। এই এলাকার মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার হার : ৩৩% দারিদ্র্যসীমার নিচে আর ১৭% অতি দারিদ্র্যসীমারও নিচে। ৩৮% মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষিত নয়, যার মধ্যে আবার ১২.৫% মানুষ উচ্চ মাত্রায় অরক্ষিত। তাহলে বুঝুন, শরণার্থী আগমনের পর পরিস্থিতির কী মারাতœক অবনতি হয়েছে।

এক্ষেত্রে একটি আশংকা অনেক বোদ্ধাকেই করতে দেখা যায়- বিদেশি সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে সাধারণতঃ কাজ করে না। বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ট রোহিঙ্গা ও সংখ্যালঘিষ্ট স্থানীয় জনগনের মাঝে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে ব্যবহার করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতঃ পুরো এলাকাকে গোলযোগপূর্ণ ও অশান্ত করে তোলার একটা আলামত ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে ফায়দা লুটবে এমন কতিপয় পক্ষ যাদের ব্যাপারে আমরা একেবারেই বেখবর। এতদুদ্দেশ্যে বার্মার লক্ষ্য হাসিল প্রচেষ্টাকেও খাটো করে দেখার আদৌ অবকাশ নেই। এবার দেখা যাক, এখানে শরণার্থী অবস্থানের কারণে স্থানীয় জনগন কী কীভাবে আক্রান্ত। Impact of the influx to Host Communities

The dramatic increase in population has strained resources, infrastructure, public services and the local economy. The most affected areas have been the Unions in Ukhia and Teknaf Upazilas, but impacts are being felt throughout the district. Increased pressures include rising food, firewood and transport prices, pressure on water, basic services and the environment and competition for jobs. The education system has been impacted due to the hiring of both teachers and students to work on the refugee response. Increased traffic congestion on the roads has led to access and safety concerns. Even before the influx, one in five households had poor food consumption patterns much higher than the national average. On average, 33% live below the poverty line and 17% below extreme poverty line. 38 per cent of the local population is vulnerable to food insecurity, of which 12.5 per cent are considered highly vulnerable. Food production in the district is scarce, leading to increased household expenditures on food and economic vulnerability overall. Environmental impacts have been dramatic: More than two thousand hectares of forest and crop land have been depleted to establish the camps and every day more forest disappears due to firewood collection (about 700 tons per day). Agricultural lands near camps are suffering from siltation and contamination from fecal matter. Irrigation wells for rice crop irrigation are also affected due to watershed destruction and diminished water table (particularly acute in Teknaf.)

পরিস্থিতির গভীরতা ও ভয়াবহতা উল্লিখিত রিপোর্ট থেকে আশা করি খানিকটা উপলব্ধি করা যাচ্ছে। আমরা এখন নিজেদের ঘরেই অসহায় বোধ করছি। সীমিত পরিসরে আমাদের যা আছে তাতে ভাগ বসিয়েছে বিশাল এক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি। মানবিক কারণে বিবেক তাড়িত হয়ে আমাদের মাঝে তাদের ঠাঁই দিয়েছি। আমাদের যা আছে তাই নিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গা ভাইদের সাহার্যার্থে এগিয়ে গিয়েছি। ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে মজলুম রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী যে জন¯্রােত ছিলো, তখনকার দিনগুলোর কথা স্মরণ করুন। কক্সবাজারবাসী তাদের সম্ভব সর্বাতœক সহযোগিতা দিয়েছে। রান্না করা ভাত রোহিঙ্গাদের সাথে ভাগ করে খেয়েছে, নিজেদের ব্যবহারের জামা-কাপড় তাদের পরতে দিয়েছে, বড় বড় ডেকসি ভর্তি খাবার রান্না করে তাদের মাঝে বিতরণ করেছে, নগদ অর্থ তাৎক্ষণিক সাহায্যরূপে বিতরণ করেছে, কোরবাণীর গোশ্ত নিজেরা না খেয়ে তাদের খেতে দিয়েছে, অসহায় মানুষগুলোকে নিজেদের ঘরে থাকতে দিয়েছে। এ সময় কিছুটা হলেও ‘আনসার-মুহাজির’ দৃষ্টান্ত আমাদের লোকেরা দেখিয়েছেন। অতঃপর রোহিঙ্গাদের ওই মানবিক বিপর্যয় বিশ^ব্যাপী আলোড়ন তুললো। মুসলিম দেশগুলোসহ মানবতাবাদী দেশগুলো তাদের সাহায্যের হাত বাড়ালো। জাতিসংঘসহ মুসলিম ও পশ্চিমা বিশে^র সাহায্য সংস্থাগুলো এগিয়ে এলো। আরম্ভ হলো ব্যাপক ভিত্তিক মানবিক সহায়তা কার্যক্রম। নিপীড়িত রোহিঙ্গারা পেলো ন্যূনতম মাথা গোঁজার ঠাঁই ও ক্ষুধা নিবৃত্তির সুযোগ। কিন্তু তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠি (host communities)

হারালো তাদের জীবন ধারণের সক্ষমতা। খাদ্য দ্রব্য, জ্বালানী কাঠ, যাতায়াত প্রভৃতির কয়েক ধাপ মূল্য বৃদ্ধি, ব্যবহার্য ও পানীয় জলের উপর বিশাল বাড়তি চাপ, মৌলিক সেবা এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব, আর সর্বোপরি চাকরীর বাজারে অসম প্রতিযোগিতা প্রভৃতির কারণে আমাদের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

এহেন সংকটকালে এনজিওগুলো ‘ছাঁটাই’ নামক খেলাটি না খেললেও পারতেন। এখানে কর্মরত এনজিওগুলো বেশিরভাগই বাংলাদেশের অন্য এলাকাতেও কর্মতৎপর। অন্য জেলার বাসিন্দাদের এবং বিগ বস’দের অতি করিতকর্মা বশংবদদের যদি একান্তই চাকরী দিতে হয় তো আমাদের ঘাড়ের উপর না বসিয়ে সেখানে দিলেই পারেন। আমরা কক্সবাজারবাসী কিছুই জানিনা তাই ভিন্ন জেলা থেকে সবজান্তাদের এনে এখানে বসাতে হচ্ছে। আমরা আনাড়িরা চাকরীর জন্য দরখাস্ত করলে তা শর্ট লিস্টেই আসে না, আউট ডোরেই রিজেক্ট হয়ে যায়। কেননা আউট ডোরে তো মামা’রাই বসে আছেন। আমাদের তো মামা নেই যে ভাগ্নেদের খোঁজ নেবে ! আর একটি বিষয় খুবই হৃদয়বিদারক। তা হলো বৌদ্ধ মগ-চাকমা-মারমা’দের দৌরাতœ্য। যে মগদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম আজ আমাদের দেশে আশ্রিত, তাদের মাথার উপর এই বাংলাদেশেও ছড়ি ঘোরাচ্ছে ওই বৌদ্ধ মগেরাই। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আইএনজিওগুলোর রিক্রুটমেন্টের প্রথম পছন্দ হচ্ছে তারা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপর ছড়ি ঘোরানোর কাজে ওই সংস্থাগুলো ওই তথাকথিত মগ’দেরই সর্বাগ্রে বাছাই করে এবং সাধারণত উপরের পজিশনে বসায়। শরণার্থী বিষয়ক তৎপরতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মগ’দের উপস্থিতি কিসের বার্তা বহন করছে ? আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে ২০০৯ সালে আমার লেখা একটি নিবন্ধ যা তখনকার সময়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো, সেখানে ওই মগদের ব্যাপারে যে কথা বলা হয়েছিলো আজ তা আরও স্পষ্ট ও প্রকট রূপ নিয়ে আমাদের ব্যঙ্গ করছে। সেই লেখার উদ্ধৃতি ‘১৭৯৫ সনে বার্মা রাজ পুরো বার্মা দখলে নিয়ে মগদের (রাখাইন) উপর অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। ফলে প্রাণ ভয়ে মগগণ দলে দলে পালংক্যিতে (কক্সবাজারের প্রাচীণ নাম) পালিয়ে আসে। তখন শরণার্থী এত বড় সমস্যারূপে দেখা দেয় যে – এদের পূনর্বাসনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ’ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স’ কে এখানে পাঠায়। গত বছর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আন্দোলনের পর যখন ব্যাপক ধরপাকড় চলে তখনও বহু সংখ্যক ভিক্ষু এদেশে পালিয়ে আসে।

তারা এদেশে এসে যেমন সকল নাগরিক সুবিধা নির্বিঘেœ ভোগ করেন তদনুরূপ সুযোগ তারা খোদ মিয়ানমারেও পান কিনা সন্দেহ। রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংঘবদ্ধতার কারণে তাদের বাংলাদেশে আসা-যাওয়া ও তৎপরতা সম্বন্ধে খুব একটা খোঁজ-খবর কেউ রাখেন না। রাস্তা-ঘাটে বা অন্যত্র তাদের কেউ চ্যালেঞ্জও করে না। তথাকথিত উপজাতি, আদিবাসী, সংখ্যালঘূ, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, পার্বত্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ইত্যাদি ছদ্মাবরণে তারা এদেশে সর্ববিধ সুযোগ-সুবিধা নির্বিঘেœ গ্রহনকারী বিদেশী অনুপ্রবেশকারী। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ তো বটেই, এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এটাকে একটি স্পর্শকাতর বিষয় জ্ঞান করে সযতেœ এড়িয়ে চলেন। ফলে তারা বাংলাদেশের স্থায়ী রাখাইন ও উপজাতি সম্প্রদায়ের ছদ্মবেশে এদেশে বিনা বাধায় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে (বিশেষ করে পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে – জাপান, কোরীয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে) পাড়ি জমান। যেহেতু বার্মা থেকে বিদেশে পাড়ি দেওয়া খুবই কঠিন বিষয় তাই তারা এদেশকে রুট হিসাবে ব্যবহার করেন। তদুপরি এক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও এনজিও – যারা বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য সাহায্য এনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তথাকথিত উপজাতি মঙ্গোলিয়ান রেস (জধপব) এর জাতিগোষ্ঠীর পেছনে দেদারছে ব্যয় করেন – যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে বার্মিজ অনুপ্রবেশকারী রাখাইন জনগোষ্ঠী। কেউ যদি বলেন অসচেতনভাবে দু’চার জন হয়ত পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে সাহায্য নিচ্ছে। আমি বলব -অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং পরিকল্পিত উপায়ে উক্ত সাহায্য সংস্থাগুলো এই বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের পেছনে বিশাল অংকের অর্থ খরচ করছে অপ্রকাশ্য এজেন্ডা (ঐরফফবহ অমবহফধ) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তন্মধ্যে – পার্বত্য এলাকায় খৃষ্ট ধর্ম প্রচার, নও খৃষ্টানদের নিয়ে বৃহত্তর জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠা, বার্মার অভ্যন্তরে অরাজকতা সৃষ্টির দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অন্যতম। কিন্তু বার্মা বিষয়ক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যেয়ে বিদেশী সংস্থাগুলো বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের নাম ভাঙ্গাবেন কেন ? কী কারণে বিশাল অংকের বিদেশী সাহায্যভোগী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠবে – তা কোনভাবে এদেশ গ্রহন না করা সত্ত্বেও।

উক্ত অনুপ্রবেশকারীরা বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং তথ্য পাচারের কাজেও জড়িত। এদেশীয় রাখাইনদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় অনুপ্রবেশকারীরা বিদেশ যাচ্ছেন, অর্থ সংগ্রহ করছেন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও জমি-জমা কিনে স্থায়ী স্থাপনা তৈরী করছেন। ভোটার তালিকাভূক্ত হচ্ছেন। স্মাগলিং এ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা এদেরই । বিশেষ করে স্বর্ণ, মাদক ও বৈদেশিক মূদ্রা পাচার এই শ্রেণীর লোকই করে থাকে বলে প্রকাশ।

সবচাইতে অমানবিক বিষয় হচ্ছে- আরাকানে যারাই নাসাকা বা স্থানীয় নামে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অত্যাচার করছে, সম্পত্তি জোরপূর্বক দখলে নিচ্ছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করছে – তাদেরই একটি অংশ এদেশে এসে পালিয়ে আসা নির্যাতীত রোহিঙ্গাদের সামনে বাংলাদেশীরূপে বীর দর্পে চলাচল করছে দেখে রোহিঙ্গাদের আফসোসের সীমা থাকে না।’

 

 

মাহ্ফুজুল হক
লেখক ও গবেষক, কক্সবাজার
২০ জানুয়ারী-২০১৯, সেল ফোন : ০১৮৬৯ ৮৬৬৯০০