নিউজ ডেস্ক:
ভারত থেকে পালিয়ে কমপক্ষে ১৩শ’ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গাদের আসা আরও বেড়ে গেছে। ভারত ছেড়ে বাংলাদেশে কেন ঢুকছেন তারা? ভয় নাকি আতঙ্ক, নাকি ভারত থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে? -এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

ভারতের জম্মু থেকে বহু পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসেছেন একটি রোহিঙ্গা পরিবার। কক্সবাজারের ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার আগে ওই পরিবারটির সঙ্গে কথা বলেন টেকনাফের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ নূরের। তিনি জানান, দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একজন বয়স্কা মহিলা ভারতের জম্মু থেকে রওনা হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসেন। তারা বলেছেন, ‘ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে, এমন খবর শুনে তারা ভয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। কারণ, প্রাণের ভয়ে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে চান না।’

খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ভারত থেকে আসা রোহিঙ্গারা সেখানেই রয়েছে। গত বছর ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভারত সরকার ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করেন। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গাদের আসা বেড়ে গেছে।

জাতিসংঘ এবং সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেই সংখ্যাটি ১৩০০ বেশি ছাড়িয়ে গেছে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, ভারত থেকে এখণ পর্যন্ত ১৩শ’ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। যারা সেদেশের জম্মু, হায়দ্রাবাদ বা নিউ দিল্লির রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করতেন। বাংলাদেশে আসা অনেকের সেখানকার ইউএনএইচসিআরের পরিচয়পত্রও রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ভারত থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু হলো। আমরা সরকারকে জানিয়েছি। তাদের নির্দেশনার ভিত্তিতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুশব্যাক নয়, এই রোহিঙ্গারা নিজেরাই জম্মু, হায়দ্রাবাদ বা নিউ দিল্লি থেকে বাংলাদেশে এসেছে বলে আমাদের জানিয়েছে। ভারত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবে, এই আতঙ্কে তারা চলে আসছেন।’

ভারত থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিবারগুলোকে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ফিরাস আল খাতিব। তিনি বলেন, ‘গতবছরের মে জুন মাস থেকেই কিছু কিছু করে তারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। তবে জানুয়ারি মাসে সংখ্যাটি অনেক বেড়েছে। নিজেদের ইচ্ছাতেই ভারত থেকে তারা বাংলাদেশে এসেছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন, কিন্তু কেন এসেছে, সেটা জানতে আরেকটু সময় লাগবে।’

এ প্রশ্নের জবাবে দিল্লিতে রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়কারী আলী জোহর বলেন, ভারত জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা ভয় তৈরি হয়েছে।

দিল্লিতে থাকা আলী জোহর নিজেও একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। সেখানে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তিনি আরও জানান, দু’মাস আগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি ফর্ম বিতরণ করে, যেটি পূরণ করে জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর থেকেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় যে, তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো হবে। এছাড়া আসাম থেকে দুই দফায় ১২ জনকে ফেরত পাঠানো হয় মিয়ানমারে। সেটাও রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করে।

ভারতে প্রায় ১৬ হতে ১৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বিভিন্ন শহরে বাস করছেন বলে তিনি জানান। তারা দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মীরসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। গত কয়েক মাসে অন্তত ২/৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ভারত ছেড়েছের বলে ধারণা আলী জোহরের। বলেন, ‘কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে তারা বাংলাদেশে যাচ্ছে। কেউ কুমিল্লা দিয়ে, কেউ সাতক্ষীরা দিয়ে যাচ্ছেন। যেদিকেই পথ পাচ্ছেন, সেদিক দিয়েই যাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘শরণার্থীরা সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএএসএফ তাদের সাহায্য করছেন। কিন্তু সীমান্তের অপর দিকে বিজিবি ধরছে। কিছু মানুষকে তারা ডিটেনশনে নিচ্ছে। পরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিচ্ছে।’

বাংলাদেশ সরকার কী বলছে
প্রতিবেশী ভারত থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের আসার বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে বাংলাদেশের সরকার? এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, তারা বিষয়টি নজরে রেখেছেন। ‘এটা আমরা শুনেছি, তবে আমাদের কাছে পুরো তথ্যটি আসেনি। আমরা বিষয়টি আরও পর্যবেক্ষণ করে বলতে পারব।’

শরণার্থী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করতে যাচ্ছে। সরকারের উচিত এখনই ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা।

তিনি বলেন, ‘ভারত আসলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে খুব একটা সংবেদনশীল না। বাংলাদেশ, এদেশের মানুষ , সরকার, সবাই অনেক বেশি সংবেদনশীল। আমাদের মনে হচ্ছে, ভারত সরাসরি তাদের বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে না, তারা কিছুটা কৌশলের অবলম্বন করছে, একটা চাপ সৃষ্টি করছে। এই মুহূর্তে তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই, সুতরাং বাংলাদেশ থেকেও তারা ফেরত যেতে পারছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘খুবই দ্রুত কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা দরকার। কারণ, বিষয়টি আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিকভাবেই সমাধান করতে হবে। প্রস্তুতি রাখতে হবে, ভারত থেকে আরও বেশি রোহিঙ্গা আসতে পারে।’

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে বিগত তিন দশক ধরে মিয়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে ৩ লাখ-এর অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে বসবাস করছেন। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বলা হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।