বিশেষ প্রতিবেদক:
খোদ গণপূর্ত বিভাগ ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই একযোগে ছোট-বড় ১৭টি স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে জোরেশোরে। একই কায়দায় সেখানে ইতিপূর্বে প্রায় অর্ধশত স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে গণপূর্ত বিভাগের আবাসিক এলাকার পূর্বপাশে গণপূর্তের সবুজ বেষ্টনি প্রকল্পের ৪.২২ একর জমিতে অবৈধভাবে প্রতিদিন প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে গড়ে উঠছে একের পর এক এসব বহুতল ভবন। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, অবৈধভাবে এসব বহুতল ভবন নির্মাণ বন্ধে ওই দু’টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব থাকলেও রহস্যজনক কারণে তারা নীরব রয়েছেন। এমনকি এসব অবৈধ কর্মকান্ড বন্ধে সচেতন লোকজন কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে তথ্যভিত্তিক লিখিত অভিযোগ দায়েরের দীর্ঘ এক মাসেও অজ্ঞাত কারণে বরাবরের মতোই চুপ রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে এলাকাবাসীরা জানান, গণপূর্ত বিভাগ ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে গণপূর্তের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে এসব বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। এমনকি স্থানীয় লোকজন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও গণপূর্তের কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে এসব বিষয়ে অভিযোগ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। সর্বশেষ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। এছাড়া বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে তথ্যভিত্তিক সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এরপরও কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেয়ায় একদিকে মূল্যবান সরকারি সম্পদ বেহাত হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে অনুমোদনহীন ভবনের কারণে অপরিকল্পিত নগরায়ণে ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হচ্ছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কলাতলী সড়কের গণপূর্তের আবাসিক এলাকার পূর্বপাশে ‘সবুজ বেষ্টনি প্রকল্প’র জমি দখল করে তাতে গড়ে উঠেছে সৈকতপাড়া। সেখানে বর্তমানে নুরুল আলম, কামাল উদ্দিন, আবুল কালাম, জসিম, মুজিব মিস্ত্রী, মোর্শেদ, কামরুল ইসলাম, হাশেম, ভূট্রো, কবির সওদাগর, মকবুল আহমদ, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারি নুরুল আলম, সাবেক বন কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন, আক্কাস, সেলিম সহ ১৭ জন দখলদার ১৭টি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ করছেন। এমনকি গণপূর্তের ৮তলা বিশিষ্ট ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ভবনের ১০ ফুট দুরত্বের মধ্যেও বেশ কিছু অবৈধ ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। গণপূর্তের আবাসিক এলাকার লোকজন অভিযোগ করে জানান, গণপূর্ত ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ের মাত্র ৫০০ গজের মধ্যে অবৈধভাবে একযোগে ১৭টি ভবনের নির্মান কাজ চললেও দুই কর্তৃপক্ষই এ বিষয়ে রহস্যজনক কারণে চুপ রয়েছে।
এলাকাবাসী আরও জানান, সরকারি জমিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নকশা ছাড়া যত্রতত্র বহুতল ভবন নির্মানের ফলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে কক্সবাজার পৌরসভা কর্তৃক নির্মাণাধীন রাস্তা এবং ড্রেইন নির্মাণেও বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া উক্ত জমিতে পরিচিহ্নিত করা সবুজ বেস্টনি প্রকল্পসহ সরকারি অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্থ হবে।

নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণের নেপথ্যে রয়েছেন কামরুল ইসলাম। তিনি নিজেও অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করছেন। সরকারি দপ্তরগুলোর সাথে ভাল সর্ম্পক রয়েছে উল্লেখ করে সাধারণ লোকজনকে অভয় দিয়ে ভবন নির্মাণের কাজে নামিয়ে দিয়েছেন তিনি। কাজ শুরু হওয়ার পর গণপূর্ত, কউক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের নামে মোটা অংকের টাকা উত্তোলন করেন। এমনকি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে তার এক নিকটাত্ত্বীয় দায়িত্বে রয়েছেন বলেও প্রচার করেন।

সূত্র আরও জানায়, দীর্ঘদিন ধরে গণপূর্ত ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে মৌখিক অভিযোগ করেও কোন ফল না পাওয়ায় ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর সচেতন ব্যক্তিরা লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। কিন্তু অভিযোগের এক মাস পার হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উপরন্তু উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে দেয়া অভিযোগটি চেয়ারম্যানের নজরে যাতে না পড়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সেই ব্যবস্থা করেছেন বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সৈকতপাড়া বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি শরাফত উল্লাহ সিকদার বাবুল বলেন, ‘লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী আমাদের সমিতির কয়েকজনকে ডেকেছিলেন। তাকে বলে আমরা সেখানে দু’তলা পর্যন্ত ভবন করার মৌখিক অনুমতি নিয়েছি। এছাড়া তৃতীয়তলায় আমরা কোন কাজ করবনা বলেও তাকে কথা দিয়েছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটি লিখিত অভিযোগ আমি পেয়েছি। এরপর সমিতি ও এলাকার কয়েকজনকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কাউকে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়নি। তারা সেখানে নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখবে বলে জানিয়েছিল। তবে এখনও সেখানে কাজ হচ্ছে কিনা তা আমার জানা নেই।’ গণপূর্তের জমিতে অবৈধভাবে নির্মাণাধীন ভবনের মালিকদের শুধুমাত্র ডেকে নিয়ে নিষেধ করেই দায়িত্ব শেষ কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে সেখানে অভিযান চালানোর মতো আমাদের ম্যাজিষ্ট্রেট নেই। ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র, নকশাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া এভাবে ভবন তৈরীতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আমি ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে কউক চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেছি।’

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অবঃ) ফোরকান আহমেদ বলেন, ‘সৈকতপাড়ার অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বে নোটিশ দিয়েছি, অভিযান করেছি। কিন্তু গণপূর্তের জমিতে অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে উঠছে, গণপূর্ত বিভাগ এক্ষেত্রে কি করছে। তাদের দায়িত্ব কি?’ এছাড়া তিনি লিখিত কোন অভিযোগ এখনো পাননি বলে জানান।