ডেস্ক নিউজ:
সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপর্যয় কাটিয়ে নব উদ্যোমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাই বিএনপির লক্ষ্য। দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। বিএনপি নেতারা এখন আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণে ব্যস্ত। বাস্তবতার নিরিখেই পথ চলতে চান দলের নীতিনির্ধারকেরা। ইতোমধ্যে ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। ভোটের অনিয়ম তদন্তে কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রেখেছেন তারা। পাশাপাশি নতুনভাবে কিভাবে কী করা যায় তা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে একাধিক বৈঠক করেছেন দলটির বিভিন্নপর্যায়ের নেতারা। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছেন। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে দলের প্রাণশক্তি তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের তথ্য জানাতে ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীদেরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের পূর্বাপর ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। বিশেষভাবে কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে দলের আইনজীবীদের কাছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, টেলিভিশনে যেসব নেতাকর্মী কথা বলেন বা টকশোতে অংশ নেন তাদের কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। এমনকি টকশোর বিষয়বস্তু জেনে তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে অংশ নেয়ার কথা বলা হয়েছে বলে দলটির নীতিনির্ধারদের পক্ষ থেকে।

বিএনপি এখন কী করবে, জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি এখন যা করার তাই করবে। বিএনপি জনগণের দল। উদার গণতান্ত্রিক দল। বিএনপি আন্দোলন করবে, গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য, জনগণের সরকারের জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি বলেন, ভোট ডাকাতি ও মহাজালিয়াতির নির্বাচনের ঘটনা সারা বিশ্ব জানে। আমি বলব, এই ফ্যাসিস্ট সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়নোই একান্ত কর্তব্য। কারণ, ক্ষতিগ্রস্ত গরিব নেতাকর্মীদের পাশে না দাঁড়ালে, তাদের জামিন না করালে, মামলার খরচ না দিলে তারা আরো বিপদে পড়বে। বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত হবে সারা দেশের জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতৃবৃন্দকে ডেকে বৈঠক করা এবং নামমাত্র কিংবা বিনা খরচে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তার নির্দেশ দেয়া। কারণ, নেতাকর্মীরা এমনিতেই বিপর্যস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। সেইসাথে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে লক্ষ্যে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই লক্ষ্য অনুসরণের জোর আহ্বান জানান তিনি।

জানা গেছে, সংগঠনকে গতিশীল করতে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেক দল, শ্রমিক দল, কৃষক দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানো হবে। শিগগিরই কাউন্সিলে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে এসব সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ করবে বিএনপি। সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে প্রার্থীদের মামলার পাশাপাশি আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েও মাঠে থাকবে দলটি। ভবিষ্যতে করণীয় ঠিক করতে বিএনপি সিনিয়র নেতারা ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি ও নতুন নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচির চিন্তাভাবনা চলছে। গত রোববার ও সোমবার এবং গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির সিনিয়র নেতারা পৃথকভাবে একাধিক বৈঠক করেছেন। প্রত্যেক বৈঠকেই স্কাইপের মাধ্যমে ভিডিও কলে সরাসরি যুক্ত থেকে কথা বলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি এই মুহূর্তে দলের করণীয় নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানান। তবে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি। এ বিষয়ে আরো পরে সিদ্ধান্ত জানাবে দলটি।

এ দিকে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম, ভোট জালিয়াতি, এজেন্ট প্রবেশে বাধা দেয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিহত ও তাণ্ডবের তথ্য জানাতে সারা দেশে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের কাছে কেন্দ্র থেকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। চিঠিতে প্রার্থীর নিজ ও তার পরিবারের ওপর হামলায় আহত এবং সম্পত্তি ক্ষতির তথ্য (ছবিসহ), ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মী, ভোটে অনিয়মের চিত্র, মামলা ও মামলায় আসামির সংখ্যা, গ্রেফতার হওয়া নেতাকর্মীদের তালিকা, ভোটে অনিয়মের ব্যাপারে প্রিজাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দাখিলের সংখ্যার কপি, ভোটকেন্দ্র জোর করে দখল, এজেন্ট ও ভোটারদের বের দেয়া কেন্দ্রের সংখ্যা ও নাম জানাতে বলা হয়েছে।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর অভিযোগ- একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মী ও প্রার্থীর পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে ১৮টি গায়েবি মামলা করে। এসব মামলায় তিন শতাধিক আসামি এবং গ্রেফতার হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এই আসনে নির্বাচনী প্রচারণাকালে ধানের শীষের সমর্থকদের ওপর হামলা করা হয়। নির্বাচনের আগের ১০ দিন বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মীর বাসা-বাড়িতে পুলিশ ও যৌথবাহিনী তল্লাশি অভিযান ও আসবাবপত্র ভাঙচুর চালায়। গত ১৯-২৬ ডিসেম্বর ১১টি মিথ্যা মামলায় ৭৮৯ জনকে আসামি এবং শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ভোটের আগের রাতেই মুরাদনগর উপজেলার সব কেন্দ্রের অর্ধেকের বেশি ভোট কেটে ফেলে।

নেত্রকোণা-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী অধ্যাপক ডা: আনোয়ারুল হক বলেন, ভোটের আগের চিত্র শুধু দেশবাসী নয় পুরো বিশ্ব জানে। ক্ষমতাসীনেরা পুলিশের সহায়তায় আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র দখলে নিয়ে জাল ভোটে বাক্স ভরে ফেলে। নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনে না থাকলে নির্বাচনের আসল চিত্র দেশের জনগণ ও বহির্বিশ্বকে দেখানো সম্ভব হতো না। এখন আমি মনে করি, সব প্রার্থীর উচিত তাদের সংসদীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। এমন নির্দেশনা আমরা কেন্দ্র থেকেও পেয়েছি। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ঝিনাইদহ-৪ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, আমি ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে আছি। মিথ্যা মামলায় আটক নেতাকর্মীদের জামিন করানোর ব্যবস্থা নিয়েছি। এই মুহূর্তে তার আসনের ১৫ জন কারবন্দী বলে জানান।

জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের সাথে গত ৩ জানুয়ারি বৈঠক করেছেন বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। বৈঠকে নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করা বা না করা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। এরপর নতুন নির্বাচনের দাবিতে ওইদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। এ ছাড়া, নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেছেন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। গত রোববার ঢাকায় একটি হোটেলে কূটনীতিকদের কাছে সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরেন তারা।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেনÑ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষপর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় সব নেতাকর্মী শত শত মামলায় জর্জরিত। তারা নিজেদের বাসাবাড়িতে ঘুমাতেও পারছেন না। এখন প্রথম কাজ খালেদা জিয়াসহ নেতাকর্মীদের জামিন ও কারামুক্তি। এরপর দল গোছানো এবং অন্যান্য বিষয়। কারণ, সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কর্মসূচি নির্ধারণের পাশাপাশি তাদের পাশে দাঁড়ানোই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।
বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ধানের শীষের প্রার্থীদের তাদের নিজ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো এবং কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য আইনজীবীদেরও সর্বোচ্চ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সার্বিক বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে তিনি জানান।