শাহীন মাহমুদ রাসেল:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাকেই ভালোবাসার কথা বলছি। আমার ভালোবাসা আমার ইচ্ছের জন্ম দেয়, স্বপ্ন দেখায়। আশাবাদী করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ভালোবাসা হলো আপনার প্রতি আমার আস্থা, ভরসার নিখাদ জমিনের ফলন। মূল কথা বলবার আগে একটু বলে নিই। তা হলো, আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, কিন্তু আমার রাজনৈতিক একজন মহান দার্শনিক আছেন। সেই মহান দার্শনিকের সুবাদে আমার দর্শণগত একটা রাজনৈতিক বোধ জন্মেছে। আমার চেতনাকে ধারণ করে, লালন করে সেই বোধ। সেই মহান দার্শনিক হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কারণেই আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন সাধারণ মানুষ। আমি বিস্মিত সাহস পেয়েছিলাম, আপনার সাহস দেখে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের আপনি যেভাবে বিচারের আওতায় এনেছেন, তা সারা বিশ্বের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক যুগান্তকারী বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বিদেশি শক্তির কাছে আপনি মাথা নত করেননি, যতই তারা শক্তিশালী হোক কিংবা সারা বিশ্বকে তারা নেতৃত্বই দিক না কেন। কত চেষ্টা, কত প্রচেষ্টা তাদের। কিন্তু কিছুই আপনাকে দুর্বল করতে পারেনি, ক্ষান্ত করেনি। আপনার সাহস, আপসহীন মনোভাব প্রমাণ করেছিল, আপনি বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা, আমার ভালোবাসার মানুষ। এভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারীর সম্ভ্রমহানির নৃশংসতা যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল, তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পর তা সম্ভব হয়েছে এবং আপনিই তা সম্ভব করেছেন। চোখের পানি বাঁধ মানেনি আনন্দে, স্বস্তিতে যখন এই যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে কোনো যুদ্ধে কিংবা দুর্যোগে অপেক্ষাকৃত বেশি নৃশংসতার শিকার হন নারী, শিশু ও বৃদ্ধিজীবীরা। একটি দেশের সংবেদনশীল এই তিন অস্তিত্বে, সত্তায় পরিকল্পিতভাবে আঘাত আসে বেশি। নারীর সম্ভ্রমকে ক্ষতবিক্ষত করা, শিশু ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা শত্রুপক্ষের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। নারী নয়, যেন একটি জাতির সম্ভ্রমের ওপর আঘাত হানা হয়। নারীর পবিত্র মাতৃত্বকে বিনাশ করা হয়, যাতে সেই দেশে সুস্থ ও উন্নত মানবসম্পদ উৎপাদন হওয়ার পথরোধ হয়, ক্ষতবিক্ষত হয়। আর শিশুরা হলো একটি জাতির আগামীর বাহক। তার ধ্বংস মানে, দেশকে এগুতে না দেয়া, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, দেশকে মানবশূন্য করে রাখা। একটি জাতির সুস্থ আগামী প্রজন্মের অস্তিত্ব না থাকা মানে, সেই দেশ ও জাতির অস্তিত্ব বিলুপ হওয়ার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করা। আর বুদ্ধিজীবী নিধন মানে, একটি দেশ ও জাতিকে মেধাহীন করে রাখা, যেন সেই দেশ ও জাতি, পরাধীনতা থেকে স্বাধীন হওয়ার কথা ভাবতে না পারে। ভাবনার সেই উপযুক্তবোধ যাতে তাদের জাগ্রত না হয়। যুগ যুগ ধরে এই সত্য স্পষ্টত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের নেপথ্যে তো পাকহানাদারদের তেমনই বর্বরতার ঘটনা ছিল।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ৯ মাসের নিরস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আহ্বানে, নেতৃত্বে। দেশ আর দেশের মানুষকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বের করে এনেছে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৪৭ বছর। একটি পবিত্র সংবিধান আমাদের হয়েছে। ৪৭ বছর একজন মানুষের জীবন সায়াহ্ন হতে পারে, কিন্তু একটি দেশের জন্য এই বয়স তেমন কিছুই নয়। মানুষ শত শত বছর বেঁচে থাকে না, সৃষ্টিকর্তা সেই সুযোগ মানুষকে দেননি। কিন্তু একটি দেশ হাজার কোটি বছর বেঁচে থাকতে পারে। বেঁচে থাকতে পারে পৃথিবী নামক উপগ্রহের সমান সমান বছর, যদি দেশটির অস্তিত্ব রক্ষা করবার দায়িত্ব সেই দেশের মানুষজন নেন। কী অবাক না, যে মানুষ নিজেই টিকছে না জগতে, অথচ সেই-ই টিকে রাখবার ক্ষমতা রাখছে একটি দেশের এবং তা হতে পারে শত কোটি বছরের জন্য। এটাই তো বিধির বিধান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি করজোড়ে লিখছি, আমাকে ক্ষমা করবেন ভুল হলে। আমাদের দেশের কন্যাশিশু ও নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। নিজ ঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে, পথেঘাটে, বাস-ট্রেনে, শহরের অভিজাত হোটেলে, থানায় ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় তারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এক বছর বারো মাসের শিশুও রক্ষা পাচ্ছে না। কোথাও কোথাও সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করতে নির্মমভাবে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। যারা ধর্ষক, তারা কিন্তু কেউ অন্য দেশ বা অন্য গ্রহের নয়। এই স্বাধীন দেশের নাগরিক। নাগরিকত্ব ভোগ করে এরা নিকৃষ্ট কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা বেশ পরিচিত, দাপুটে, প্রভাবশালী। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এরা ধৃষ্টতা দেখায়। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, থেকে যায়। এমন অভিযোগ ধর্ষণের শিকার নারীর, তার পরিবারের প্রায় প্রতিদিন। ধর্ষক আইনকে ভয় কিংবা পরোয়া করে না। কেন করে না ভয়? কারণ এদের সবার বিচার হয় না। ভাবুন! তার এই অকুতোভয় বিকৃত আচরণ সংক্রমিত হয় অন্য দুর্বল চিত্তের পুরুষের মাঝে অবলীলায়। ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হয় আর কেউ, নতুন ধর্ষক জন্ম নেয়। পরিষ্কার যে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধকে প্রসারিত হতে সহায়তা করে, নতুন অপরাধীর জন্ম দেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নারীর প্রতি সহিংসতার বিচার দ্রুত না হওয়া, শাস্তি সুনিশ্চিত না হওয়া অপরাধীকে বেপরোয়া করে দিচ্ছে ক্রমান্বয়ে। কন্যাশিশু ও নারীরা আজ ভীতসন্ত্রস্ত। চলাচলে তারা স্বাভাবিক নিরাপদবোধ করে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সামাজিক অবক্ষয় রোধে বা যে কোনো অপরাধ দমনে পরিবারের ভ‚মিকা আছে, মানি। পরিবার গড়ে ওঠে সমাজে। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণায়, বিশ্বাসে এবং তা সমাজকে টিকিয়ে রাখতে। সেই সমাজ কী শিক্ষা দিচ্ছে বা ভূমিকা রাখছে পরিবারকে দায়িত্বশীল বা দায়বদ্ধ করে রাখতে, সঠিক পথে চলতে? আর সমাজকেইবা সুষ্ঠুভাবে, সুস্থভাবে, আইনসঙ্গতভাবে পরিচালনার দায়িত্ব কার থাকছে? ঘুরেফিরে আসে মায়ের দোষ, অভিভাবকের দোষ, সন্তান গড়ে তুলতে পারেনি। ভীষণ কষ্ট পাই। কান্না আসে। হতাশ হই দ্বিগুণ, যখন দেখি পাঠ্যপুস্তকেও নারী অবহেলার শিকার।

যৌন নিপীড়নের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে কিশোরী শিক্ষার্থীকে শেখানো হচ্ছে, যেন সে একা ঘরে না থাকে! কিশোরীর মা-বাবা যদি চাকরিজীবী হন, তাহলে কে থাকবে তার সঙ্গে? আর এটা কেমনইবা শিক্ষা? এই শিক্ষা কি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যর্থতার কথা বলছে না পরোক্ষভাবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? কষ্ট বাল্যবিয়ে নিরোধ বিলের বিশেষ ক্ষেত্রে ‘ছাড়’ এর মধ্যেও। বলা হয়েছে প্রতিবন্ধীদের অভিভাবক না থাকলে তাকে নির্ধারিত বয়সের আগে বিয়ে দেয়া যাবে। কী সাংঘাতিক কথা! একজন প্রতিবন্ধী কিশোরীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সক্ষমতা, সবলতার কথা ভাবা হলো না! বিয়ের পরে যেখানে একজন স্বাভাবিক নারীই নতুন পরিবেশের সঙ্গে, দাম্পত্য সম্পর্কের সঙ্গে, প্রজনন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমন্বয় করতে হিমশিম খেয়ে যায়, সেখানে একজন প্রতিবন্ধী কিশোরীর জন্য এমন ভাবছি কেন আমরা? এটা কী পরোক্ষভাবে একজন প্রতিবন্ধী কিশোরীর অভিভাবকত্ব গ্রহণে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কথা বলে না? রাষ্ট্র নিশ্চিত হয়েছে যে, তার পক্ষে একজন প্রতিবন্ধী কিশোরীর অভিভাবকত্ব গ্রহণ সম্ভব নয়?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যদি নারী নিগ্রহের বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের কাছে দেখবার চেষ্টা করেন, আমি নিশ্চিত আপনি ক্ষুব্ধ হবেন, মন খারাপ করবেন, হতাশ হবেন। আপনার মেনে নেয়ার কথা নয়। এই পাশবিকতা একাত্তরের পাকবর্বরতার অধিক কিনা, তা ভেবে দেখবার দায়িত্ব আপনিই নিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! তখন ছিল এ দেশ পরাধীন, আর এখন স্বাধীন। একটি স্বাধীন দেশে এমন নারী নিগ্রহের ঘটনা কে ঘটায়, ঘটাতে পারে, দুঃসাহস পায়?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে বলুন, এ দেশ হবে ধর্ষণমুক্ত নারীবান্ধব একটি দেশ। কোনো ধর্ষকের জায়গা নেই এই মাটিতে। কেউ যদি নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে, সে যেই হোক তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এবং শাস্তিটা হবে ফাঁসি। আপনিই পারবেন ধর্ষণমুক্ত করতে এই দেশ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আমার করজোড় আবেদন!