বিদেশ ডেস্ক:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ঐতিহাসিক জয় পেলেও অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধীরা। শপথ নেননি বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত বিএনপি ও গণফোরামের ৭ আইনপ্রণেতা। নির্বাচনি অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তবে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে অভিনন্দন বার্তা আসতে থাকায় তদন্তের প্রশ্নে শেখ হাসিনা চাপমুক্ত থাকতে সক্ষম হচ্ছেন। এপির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, অভিনন্দন বার্তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রধানমন্ত্রীকে নির্ভার রেখেছে। একজন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষককে উদ্ধৃত করে ওই মার্কিন বার্তা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক দশকের শাসনে অর্জিত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, প্রভাবশালী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন শেখ হাসিনা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট। প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে মাত্র সাতটি আসন। টানা তৃতীয় দফায় চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার সংসদ নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ সোমবার।

এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশাল ব্যবধানে পুননির্বাচিত হয়ে অভিনন্দন জোয়ারে ভাসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনি অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের ব্যাপারে খুব একটা ভাবছেন না তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময়ে ওঠা অনিয়মের অভিযোগের কারণে প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট ছিল না। তবে ভারত আর চীনের অভিনন্দন বার্তা পরিস্থিতি বদলে দেয়। একে একে বার্তা পাঠায় সৌদি আরব, রাশিয়া, কাতার, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভুটান ও পাকিস্তান। অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখার আহ্বান জানালেও সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি আসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকে।

২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর সতর্কতার সাথে ভারত, চীন, রাশিয়া ও সৌদি আরবের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের সফল সূচনা ঘটান শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে তা অব্যাহত রাখেন। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে গড়ে ওঠা সৌদি নেতৃত্বাধীন ৩৪ জাতির একটি সামরিক জোটে যোগ দেয় শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে মিলে শুরু হয় প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ। চীনের কাছ থেকে কেনা হয় দুটি সাবমেরিন। জাপানকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের বিনিয়োগে।

সস্তা শ্রমের কারণে চীনের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রফতানিকারক বাংলাদেশ। এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রফতানি করা তৈরি পোশাক থেকে বাংলাদেশের বার্ষিক আয় ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এদিকে বাংলাদেশের আমদানির শীর্ষ দুই উৎস চীন ও ভারত। এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবির বলেছেন ‘আমরা তাদের কাছে থেকে আমদানি করি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে রফতানি করি।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক কবির মনে করেন, বাণিজ্যের বাইরে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। ‘মূল্যবোধ হিসেবে আমরাও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সুতরাং সেই প্রশ্নেও আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত’। ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সূত্রেও পশ্চিমের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রয়েছে বলে মন্তব্য করেন কবির। তাদের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরেন তিনি।

উল্লেখ্য, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন পরবর্তী এক বিবৃতিতে সহিংসতা, হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ জানালেও সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অভাবনীয় রেকর্ড আর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় আখ্যা দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কাজকে আরও এগিয়ে নিতে ক্ষমতাসীন সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। ইতিবাচক বার্তা এসেছে সৌদি আরবের তরফ থেকেও। বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আজিজ ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও মানবাধিকার হরণের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘসহ এর মানবাধিকার কমিশন। তদন্তের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকেও অনিয়মের অভিযোগগুলো স্বাধীনভাবে তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে চিন্তিত নন শেখ হাসিনা।

বিশ্লেষক কবির বলছেন, বিগত ১০ বছরের শাসনে শেখ হাসিনা প্রভাবশালী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সফল সম্পর্ক গড়তে সক্ষম হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন তিনি। ‘উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির প্রশ্নে বাংলাদেশ এখন একটি ভালো দৃষ্টান্ত। পাশাপাশি নির্বাচনে শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ বিজয় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভোটারদের রাজনৈতিক সমর্থনের প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছে।’

হুমায়ুন কবির মনে করছেন, ভোটের ফলাফলে দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের কীর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলছে আর দুর্দান্ত ফলাফলের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

এপির প্রতিবেদনে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় ১২ জনেরও বেশি নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারণার সময়ে বিরোধীদের ওপর আটক অভিযান পরিচালনার কথাও উল্লেখ করেছে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে রাখা হলেও একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করে তার সমর্থকরা। নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উপেক্ষার প্রসঙ্গও আছে ওই প্রতিবেদনে। আলোচনায় এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করার প্রসঙ্গও। তবে হুমায়ুন কবিরের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে স্থিতিশীল দেখতে চায়। তার ভাষ্য, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমাদের শ্রম খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, অবকাঠামোতে অধিকতর উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো যুগোপযোগী করার দৃষ্টান্ত প্রয়োজন আমাদের। কারণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা এই ইস্যুগুলো খেয়াল করে। এসব কারণেই তারা বাংলাদেশকে এখন ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে’।

স্থিতিশীল বাংলাদেশের স্বার্থেই নির্বাচনে অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই কূটনীতিক।