ইমাম খাইর, সিবিএনঃ
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, হামলা-মামলা, বিক্ষিপ্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা।
শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) সকাল ৮টা থেকে প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা ভোটের। প্রার্থী ও ভোটারদের অপেক্ষা করতে হবে আরও দুই দিন (৪৮ ঘণ্টা)। বহুকাঙ্খিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হবে বলে প্রত্যাশা করছে জেলার ভোটাররা।
জেলার চারটি আসনে শেষ দিনে জম্পেশ প্রচারণা চালিয়েছেন প্রার্থীরা। জেলার বিভিন্ন স্থানে টানটান উত্তেজনার পারদ ছড়িয়ে ভোট টানতে ব্যস্ত দেখা গেছে প্রার্থীদের।
প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের প্রচারণা ও বেশ উপভোগ্য ছিল।
প্রশাসনের কড়াকড়ির কারনে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ দিনে প্রার্থীরা পথসভা এবং শেষ নির্বাচনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে বলে দাবি প্রশাসনের।
তবে, কক্সবাজার শহরের কালুর দোকান, খুরুশকুল ব্রিজ এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় শেষ নির্বাচনী পথসভায় বিএনপির নেতাকর্মীদের পথে পুলিশের বাধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তবু বড় ধরনের ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ প্রচারণা।
আগামী রবিবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে ভোটগ্রহণ। কোনও বিরতি ছাড়া চলবে ওইদিন ৪টা পর্যন্ত। ওই জনরায়ের ফলে গঠিত হবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নতুন সরকার।
২৮ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে সারা দেশে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ এবং ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে সড়ক ও নৌপথে যানচলাচল বন্ধ থাকবে।
কক্সবাজার জেলার ৪টি পৌরসভা ও ৭১ ইউনিয়নের ৫১২ ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ২০৪ জন। সেখানে ৭ লাখ ৭ হাজার ৮৩১ জন পুরুষ এবং ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭৩ জন মহিলা। ভোট কক্ষের সংখ্যা ২ হাজার ৭৩৮টি।
জেলার চারটি সংসদীয় আসনেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ববি হাজ্জাজের দল এনডিএম ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীসহ মোট প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ২৯ জন। সেখান থেকে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী বর্তমান এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ মোহিবুল্লাহ সরকারী দলের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে চুপসে গেছেন।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ড. আনসারুল করিম ও ইসলামিক ফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী কাজি মনজুর আহমদও কক্সবাজার-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আশেক উল্লাহ রফিককে সমর্থন দিয়েছেন। বাকী প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে আছেন। যে যার মতো করে প্রচারণা চালিয়েছেন।

জনগণের বহু প্রত্যাশিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার জেলার চার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগ ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা। এর মধ্যে তিন আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং একটি আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জামায়াত মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা কেউই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই।
জেলার চার আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইল হবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
কক্সবাজার-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাহ উদ্দীন আহমদের স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমদ এবং চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলম। শুরু থেকে নানা উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে এই আসনটি জেলায় বেশ আলোচনায় রয়েছে। দুই প্রার্থী মাঠে নামলেও মাঝপথে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বাধার মুখে বিএনপি প্রার্থী হাসিনা আহমদ শেষ পর্যন্ত প্রচারণা চালাতে পারেননি বলে অভিযোগ তাঁর। তবে এরমধ্যে দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকটি পাল্টাপাল্টি হামলা ঘটনার ঘটে গেছে। তবুও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ হলে এই আসনে তুমুল লড়াই হওয়ার আভাস রয়েছে।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন তিন প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী কারাবন্দী জামায়াত নেতা এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ ও ধানের শীষের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর ফরিদ। এই আসনে শুরুতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন- আশেক উল্লাহ রফিক, হামিদুর রহমান আযাদ ও ড. আনসারুল করিম। প্রথমে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে কাগজপত্র জমা দিতে না পারায় আলমগীর ফরিদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছিল। পরে তিনি কয়েক দফা আইনী লড়াই করে ধানের শীষের প্রতীকসহ প্রার্থীতা ফিরে পান। কিন্তু তিনি মাঠে নামার দু’দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবানে সরে দাঁড়িয়ে আশেক উল্লাহর রফিকের জন্য মাঠে নেমেছেন ড. আনসারুল করিম। শেষ মুহূর্তে তিন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তিন প্রার্থীই শক্তিমান হওয়ায় এই আসনে ভোটে ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার আভাস রয়েছে।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাইমুম সরওয়ার কমল ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। পর্যটন নগরীর এই আসনে মাত্র এই দু’প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকায় প্রচারণার যুদ্ধ বেশ জমজমাট ছিলো। তবে লুৎফুর রহমান কাজলের প্রচারণায় শুরু থেকে বাধা দেয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কারণে দু’পক্ষের মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। দু’প্রার্থীই জাদরেল হওয়ায় এই আসনেও তুমুল ভোটযুদ্ধ হওয়ার আভাস রয়েছে।
তবে, কক্সবাজার সদর আসনটিতে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী মফিজুর রহমানও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় তৎপর ছিলেন।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী।
বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির স্ত্রী শাহীন আকতার ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী মূল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। সীমান্তবর্তী এই আসনে জাতীয় পার্টির পক্ষে মাস্টার এমএ মঞ্জুর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মাওলানা মোঃ শোয়াইব, ববি হাজ্জাজের দল এনডিএম এর এডভোকেট সাইফুদ্দিন খালেদও শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন।
ভোটের হিসাবে শাহীন আক্তার ও শাহজাহান চৌধুরী এই দু’প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার আভাস রয়েছে। তবে শাহজাহান চৌধুরীর অভিযোগ, আবদুর রহমান বদি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তাঁর প্রচারণায় মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার ও এলাকাছাড়া করেছেন। সে কারণে তিনি প্রচারনায় পিছিয়ে ছিলেন। তবে ভোটের যুদ্ধে ঠিকই দু’প্রার্থী মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছে ভোটাররা।

এদিকে নির্বাচনের জন্য জেলায় জেলায় পাঠানো হচ্ছে ব্যালট পেপার।
গত দুই দিনে জেলায় জেলায় ব্যালাট পেপার পাঠিয়েছে ইসি। এর আগে ব্যালাট পেপার ছাড়া অন্যান্য নির্বাচনী সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে স্টাম্প প্যাড, অফিসিয়িাল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল, লাল গালা, অমোচনীয় কালির কলম, হেসিয়ান বড় ব্যাগ, হেসিয়ান ছোট ব্যাগ, চার্জার লাইট, ক্যালকুলেটর, স্ট্যাপলার মেশিন ও স্টাপ পিন ইত্যাদি সামগ্রী পাঠানো হয়েছে।
জেলার চারটি আসনে ভোটের পরিসংখ্যান:
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া):
চকরিয়া উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়ন এবং পেকুয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন নিয়েই কক্সবাজার-১ আসনটি গঠিত।
এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৮১ জন। ভোটকেন্দ্র সংখ্যা ১৩৯টি।
চকরিয়া উপজেলায় ১৮টি ইউনিয়নের ৯৯টি ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে এক লাখ ৪৮ হাজার ৮০৫ জন পুরুষ ও এক লাখ ৩৫ হাজার ৬০৬ জন নারী মিলিয়ে ভোটার রয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৪১১ জন।
পেকুয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ৪০ ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ৫৫ হাজার ৬২০ জন পুরুষ ও ৫০ হাজার ৬৫০ নারীসহ ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৬ হাজার ২৭০ জন।
কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী):
কুতুবদিয়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন এবং মহেশখালী উপজেলার একটি পৌরসভার ৮টি ইউনিয়ন নিয়েই কক্সবাজার-২ আসনটি গঠিত।
এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৯৬ হাজার ৮১ জন। ভোটকেন্দ্র সংখ্যা ১০৫টি।
কুতুবদিয়া উপজেলায় ৬ ইউনিয়নের ৩৭টি ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ৪৪ হাজার ২৩ জন পুরুষ ও ৪০হাজার ৪৪২ জন নারী মিলিয়ে ভোটার রয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৪৬৫ জন।
মহেশখালী উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নে ৬৮ ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৯ জন পুরুষ ও ১ লাখ ১ হাজার ৬৬৭ নারীসহ ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ১১ হাজার ৬১৬ জন।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু):
কক্সবাজার সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন এবং রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়েই কক্সবাজার-৩ আসনটি গঠিত।
এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১৪ হাজার ৩৬ জন। ভোটকেন্দ্র সংখ্যা ১৬৮টি।
সদর উপজেলায় ১০৮টি ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে এক লাখ ৩৫ হাজার ১৪ জন পুরুষ ও এক লাখ ২১ হাজার ৪ জন নারী মিলিয়ে ভোটার রয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার ১৮ জন।
রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ৬১ ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ৮১ হাজার ৪১০ জন পুরুষ ও ৭৬ হাজার ৬০৮ নারীসহ ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৫৮ হাজার ১৮ জন।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ):
উখিয়া উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন এবং টেকনাফ উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নিয়েই কক্সবাজার-৪ আসনটি গঠিত।
এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪০৬ জন। ভোটকেন্দ্র সংখ্যা ১০০টি।
উখিয়া উপজেলায় ৪৫টি ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ৬০ হাজার ৪৮৮জন পুরুষ ও ৫৮ হাজার ২৯৭ জন নারী মিলিয়ে ভোটার রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৫ জন।
টেকনাফ উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৬টি ইউনিয়নে ৫৫ ভোট কেন্দ্রের বিপরীতে ৭২ হাজার ৫২২জন পুরুষ ও ৭৩ হাজার ৯৯ নারীসহ ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৪৫ হাজার ৬২১ জন।