আতিকুল ইসলাম

হ্যাঁ কিছু মানুষের কথা বলতে চাই। যারা ক্লান্তিকর রাতের মাঝেও আকাশের চাঁদ দেখার জন্য ঝিম মেরে বসে থাকে। কিন্তু ওরা শুধু বসেই থাকে, না হয় চাঁদ দেখা, না হয় শুয়ে থাকা। হ্যাঁ। ওরা শুধুই বসে থাকে। চাঁদ দেখার জন্য। আমি যাদের কথা বলতে চাই তারা তিন জন। সেই তিন জনের মধ্যে আমি কিন্তু একজন থাকবই। এখন আমি ‘আমরা’ করে বলা শুরু করবো।

আমরা তিন জন। শফিক, আসাদ, মানিক। আমরা তিনজন চাঁদের আলো পান করার জন্য বসে আছি। কিন্তু বোকা চাঁদ আমাদের আলো না দিয়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। কি বোকা! আকাশের একটি অংশ ঈষৎ আলোকিত হয়ে রয়েছে। সেই আলোতে আমাদের প্রয়োজন মিটবে না। আমাদের অনেক আলো প্রয়োজন।

আমরা তিনজনই ক্ষুধার্ত। চাঁদের আলো আমাদের বড় প্রয়োজন। চাঁদের আলো না পাওয়ায় আমাদের মন ব্যাথিত। হৃদয়ের গভীর থেকে গভীর কান্না বেড়িয়ে আসে। সেই কান্নার ফোঁটাগুলো আমরা কেউ কোথাও দেখি না। কারণ দুষ্ট মেঘ হতে ঝিরঝির বৃষ্টি আমাদের কান্নার ফোঁটা কিনে নিয়েছে। সে বলেছে তোমরা কান্নার ফোঁটা আমার বৃষ্টির ফোঁটার সাথে মিশিয়ে মাটিতে ফেলে দেও। সত্যি বলছি তাহলে আমি সরে যাব। তোমরা চাঁদের আলো পান করতে পারবে। তাই আমরা রাজি হয়েছি। কান্নার ফোঁটাকে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে মিশিয়েছি। মিশ্রিত বৃষ্টি-কান্না ছুঁড়ে দিয়েছি মাটিতে।

কিনতি পাজি মেঘ জমিদার তার মেঘের জমি এখনো সরিয়ে নেয় নি। মনে হচ্ছে না আজ যাবে আর। এটাই তো সত্য ঘটনা। কারণ আমরা শুধু ক্লান্তিকর রাতে ঝিম মেরে বসেই থাকব। চাঁদের আলো পাওয়া হবে না।

তারপর আমরা আমাদের মনের কথা বোঝা শুরু করব। একে একে তিনজনের মন কিচ্ছুক্ষণ চিৎকার করতে থাকবে। একে একে তিনজন। সে সকল চিৎকার শুধু মনের মাঝেই প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করবে আর মেঘের দিকে ছুটে যাবে।

প্রথমে চিৎকার করবে লাল রঙের শফিকের মন। সে মন চিৎকার করে বলবে, বোন আমার ফিরে আয়। সেই কখন ছোট্ট বেলায় তোকে দেখছি। কাঁচের চুড়ি কিনে দেব বলেছি। কিন্তু দেই নি। কি করব বল আমি যে তখনো রোজগার শিখি নি। পায়ের আলতা চেয়েছিলি। কিনে দেব বলেছি। কিন্তু দেই নি। তর আর মার অনেক কষ্ট হত। মশারি ছাড়া তোরা থাকতে পারতিস না। মশারি কিনে দিব বলেছি। কিনে দেই নি। তুই কত দিন বলেছিস তর বান্ধবী উঁচু জুতা পরে। তরও শখ হয়। আহ্। আমি তাও পারি নি। তারপর একদিন কত অভিমানই না করলি। আমি কত বোঝালাম, হিল কিনে দিবো, আলতা কিনে দিবো, কাঁচের চুড়ি কিনে দিবো। তুই কোন কথাই শুনলি না। শুধু রাগই করলি আর চলে গেলি তারার দেশে। সেদিন ঘরে কেরোসিনের প্রদীপ জ্বলছিল। আমি আর মা কত খুঁজলাম। কই? কেরোসিনের বোতলটা তো খুঁজে পেলাম না। সেই যে আলো নিভল আর জ্বলে নি। তাতে কী হয়েছে? আকাশে যে চাঁদ ছিল। সেই চাঁদের আলোয় দেখলাম তুই ফুল পরীর মত আকাশে ডানা মেলে চলে গেলি। আর ফিরে এলি না। এত অভিমান করা কী ঠিক! বোন আমার ফিরে আয়। আসবি না? আয় না, এরপর লাল রঙের শফিকের মন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই নিঃশ্বাস বুলেটের মত ছুটে যায় মেঘের দিকে। মেঘ যেন একটু ভয় পায়।

তারপর শুরু হয় কালো মনের মানিকের আর্তনাদ। তার মনটা বড় কালো হয়ে গেছে। খুব কালো। কয়লার চেয়েও বেশি কালো। তবে একটু কেন যেন শান্তি পাগল কালো। এ কালো দেখলে শান্তিতে মন ভরে যায়। এ কালো নর্দমার কালো নয়, অন্য কালো। ধীরে ধীরে এই কালো মন সামান্য কালো ধূলা ছড়িয়ে জেগে উঠে। তারপর ধীরে ধীরে বলতে থাকে, মা তুমি কি আমাকে দেখছ? আমি কিন্তু তোমাকে দেখছি না। আমি তোমাকে দেখতে চাই না মা। কিন্তু আমাকে যেন তুমি দেখ। ঠিক যেমনটি দেখতে পুকুর পারের কলা গাছ বাঁধানো স্থান হতে। তুমি রাগী রাগী চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি তবু কথা শুনতাম না। সাঁতার কেটেই যেতাম, কেটেই যেতাম। এক সময় তুমি চলে যেতে। কিন্তু মা এখন কেন আমাকে ডাকতে আস না? তুমি যাওয়ার পর আমিতো আর পুকুরে নামি না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুকুরে সাঁতার কাটি না। তবু তুমি চলে গেলে। মা আমি আর বাবুদের গাছ থেকে লিচু চুরি করি না। তোমার মত করে কেউ আর আমাকে বোকে না। তুমি আস না কেন মা? সেই জ্বরের ঘোরে তুমি কত কিছুই না বলেছিলে। আমি কিছুই বুঝি নি। তারপর তোমাকে যখন মাটির ঘরে দিয়ে আসলাম, আমি তখনও তোমার কথা শুনছিলাম। কতো ভয় পেয়েছিলাম জান? বাঁশ ঝাড় নড়ে উঠেছিল। আকাশের চাঁদ ছিল বলে পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম। তুমি আর আসবে না? তুমি চলে যাওয়ার পর বাবার সাথে আরও একজন ছিল। টানা টানা ভ্রু, কুচকুচে কালো চুলের নতুন মা। আমাকে কত আদর করল। কিন্তু কই তোমার আদরের মত হয় না যে। তারপর আমি শুধু বার বার বেড়িয়ে যেতাম। তোমার মাটির ঘরের পাশে বসে থাকতাম। আর কী করতাম জান? আকাশের চাঁদের আলো পান করতাম। দেখা দেও মা। আমি আজ আর তোমার অবাধ্য হব না। তুমি যা বলবে তাই করবো। ঘুমাতে বললে ঘুমাব, পড়তে বললে পড়ব। আস না। দয়া করে একটি সেকেন্ডের জন্য আস। এরপর কালো রঙের মানিকের মন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাস বুলেটের মত ছুটে যায় মেঘের দিকে। মেঘ আর একটু ভয় পায়।

আর বাকি রইল আসাদ বা আমার আকাশের মত নীল রঙের মন। এ মন কিছুটা অভদ্র প্রকৃতির। ঠিক যেমনটি বলে ডাকত সেই স্বপ্নালু চোখের রমণী। তাকে আমি কী বলে ডাকবো। রমণী তুমি যেখানে যত দূরে ফুল হয়ে থাক না কেন, ফিরে আসো। বিশ্বাস করতে পার? আমার অনেক কষ্ট। এ কষ্ট তোমাকে হারানোর কষ্ট নয়। তোমার শেষ গোসলে ভেজা সিক্ত চুল দেখতে না পারার কষ্ট। শুভ্র কাফনের কাপড়ে তোমাকে আমি দেখতে পারি নি। তোমাকে আমি দেখতে পারি নি যখন তুমি মাটির সাথে মিশে গেলে। তোমার মত করে এখন আর কেউ হাতে হাত রাখে না। কেউ আর স্বপ্ন দেখায় না। কেউ সিগারেট খাওয়ার জন্য বোকা দেয় না। কেউ আর মাথা ধরানো সৌন্দর্য দেয় না। আমি শুধু একাই থাকি। একটার পর একটা সিগারেট শেষ করি। তবু মনে হয় তুমি হয়ত আসবে একদিন। আকাশ বাতাস ছড়িয়ে তোমার বিশাল ডানা থাকবে। সত্যি বলছি তবু আমি ভয় পাব না। তাই ফিরে আস তুমি ফিরে আস।

তারপর নীল রঙের আসাদ বা আমার মন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। সেই নিঃশ্বাস বুলেটের মত ছুটে যায় মেঘের দিকে।

এবার মেঘ্র মহারাজার ভয় আতঙ্কে রূপ নেয়। সে তার বিশাল সম্রাজ্য নিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে যায়। আর ফিরে আসে না। আর মেঘের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া চাঁদ তার সব আলো উজাড় করে দেয়। আমারা খেপা ক্ষুধার্ত কুকুরের মত চাঁদের আলো পান করতে থাকি। এক সময় আমাদের মন চাঁদের আলোয় পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না। কারণ আমি যাদের কথা বলতে চাই তারা ক্লান্তিকর রাতের মাঝেও আকাশের চাঁদ দেখার জন্য ঝিম মেরে বসে থাকে। কিন্তু তবু এমন হয়ে গেলো। এরপর আমাদের তিনটি দীর্ঘশ্বাস একত্রে মিশে শান্তির রঙ সাদায় পরিণত হয়। আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করি শান্তির জগতে।